নভেম্বরের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি হিলারি ক্লিনটনকে জেলে পাঠাবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় হিলারি যেসব ই-মেইল পাঠিয়েছিলেন, তার অনেকগুলো বেআইনিভাবে মুছে ফেলেছেন সে কথা উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, হিলারির এই অপরাধ তদন্তের জন্য তিনি একজন বিশেষ তদন্তকারী নিয়োগ করবেন।
সে কথার জবাবে হিলারি ক্লিনটনের মন্তব্য ছিল, ভাগ্যিস ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো মেজাজের কেউ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নেই। হিলারির কথা শেষ হওয়ার আগেই ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ‘তাহলে তুমি জেলে থাকতে।’
যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় গত রোববার রাতে (বাংলাদেশ সময় গতকাল সোমবার সকাল‍) সেন্ট লুইসের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় নির্বাচনী বিতর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও হিলারি ক্লিনটন ৯০ মিনিট ধরে কঠোর ভাষায় একে অপরকে আক্রমণ করেন। এ কাজে নেতৃত্ব দেন ট্রাম্প। তিনি হিলারিকে মিথ্যাবাদী, শয়তান ও প্রেসিডেন্ট হওয়ার অযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। তিনি অভিযোগ করেন, সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে হিলারি কোটি কোটি ডলার নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন। তাঁর হৃদয়ে ঘৃণা রয়েছে, সে কারণে তিনি আফ্রিকা-আমেরিকা অধ্যুষিত শহরতলিতে দারিদ্র্য দূর করতে কোনো ব্যবস্থা নেননি। এমনকি হুমায়ুন খান নামের যে মুসলিম আমেরিকান সৈনিক ইরাক যুদ্ধের সময় নিহত হন, তার জন্যও দায়ী হিলারি। কারণ সিনেটর থাকাকালে তিনি ইরাক যুদ্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন।

জবাবে হিলারি ট্রাম্পের মতো মেজাজের একজনকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার অযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। কিঞ্চিৎ পরিহাসের সঙ্গে তিনি বলেন, ট্রাম্প নিজের গড়া ‘বিকল্প বাস্তবতায়’ বাস করেন।

.একাধিক ভাষ্যকার এই বিতর্ককে আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসের ‘সবচেয়ে নোংরা’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে তিক্ততা এতটা গভীর ছিল যে বিতর্কের শুরুতে কেউ কারও সঙ্গে করমর্দন পর্যন্ত করেননি। মাত্র দুই দিন আগে প্রকাশিত এক ভিডিওতে নারীদের ব্যাপারে অশ্লীল ও আপত্তিকর মন্তব্য ধরা পড়ার পর থেকে ট্রাম্প সব মহল থেকেই তীব্র সমালোচনার মুখে ছিলেন। তাঁর নিজের দলের অনেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সিনেট ও কংগ্রেস সদস্য তাঁর প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেছেন। কেউ কেউ ট্রাম্পকে বাদ দিয়ে দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মাইক পেন্সকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়নের প্রস্তাবও করেছেন।
এই রক্তক্ষরণ ঠেকাতে বদ্ধপরিকর ট্রাম্পের জন্য এই দ্বিতীয় বিতর্ক ছিল টিকে থাকার শেষ চেষ্টা। সে লক্ষ্যে হিলারির স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের নারীঘটিত অভিযোগ নতুন করে তুলে আনেন ট্রাম্প। বিতর্ক শুরুর মাত্র দেড় ঘণ্টা আগে তড়িঘড়ি করে ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিল ক্লিনটনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন এমন তিনজন নারীকে হাজির করেন। প্রায় চার দশক আগে ধর্ষণের শিকার এমন একজন ১২ বছরের কিশোরীর বিরুদ্ধে হিলারি সরকারি আইনজীবী হিসাবে আগে দায়িত্ব পালন করেন। সেই কিশোরী এখন পরিণত বয়সের নারী, তাঁকেও ট্রাম্প হাজির করেন। বিতর্ককক্ষে দর্শকের প্রথম সারিতে এই চারজনকে বসে থাকতে দেখা যায়।
এ সবই ছিল বেঁচে থাকার জন্য ট্রাম্পের শেষ কামড়। বিতর্কের পুরোটা সময় তাঁকে মনে হচ্ছিল খাঁচায় বন্দী বাঘ। তিনি সারা মঞ্চ হেঁটে বেড়ান, কখনো কখনো হিলারির চেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়ান, তাঁর মুখ ছিল ক্রুদ্ধ ও আক্রমণাত্মক। অন্যদিকে হিলারি ছিলেন শান্ত, পরিকল্পিত ও আবেগহীন। তাঁর বক্তব্য ছিল অতি দক্ষ আইনজীবীর মতো। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আক্রমণের বিস্তর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি তা ব্যবহারে ব্যর্থ হন অথবা পরিকল্পিতভাবে তা এড়িয়ে চলেন। অনেকেই ভেবেছিলেন, ভিডিও টেপের ঘটনার পর ট্রাম্পকে চূড়ান্তভাবে নাজেহাল করার সুযোগ হিলারি ব্যবহার করবেন। কিন্তু তিনি সে পথে যাননি।
শুরুতেই ভিডিও টেপের প্রসঙ্গটি ওঠে। বিতর্কের অন্যতম সঞ্চালক এন্ডারসন কুপার এই ভিডিওতে তাঁর কথাকে ‘যৌন আক্রমণ’ হিসেবে অভিহিত করলে ট্রাম্প সাদামাটাভাবে নিজের বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। ‘এ কেবল কথার কথা, খেলোয়াড়দের পোশাকঘরে এমন কথা হয়েই থাকে।’ কুপার একাধিকবার জানতে চান, ভিডিওতে বলা যৌন আক্রমণের কোনো ঘটনা তিনি করেছেন কি না। জবাবে ‘না, আমি করিনি’ বলে দ্রুত বিষয় পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্ট হলে আইএসকে তিনি কীভাবে নির্মূল করবেন, সে কথা বর্ণনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রশ্ন ও পাল্টা প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে ট্রাম্প কিছুটা মরিয়া হয়েই বিল ক্লিনটনের প্রসঙ্গ তুলে এনে বলেন, ‘আমি শুধু কথা বলেছি, কিন্তু বিল ক্লিনটন সে তুলনায় নারীদের সঙ্গে অনেক, অনেক খারাপ কাজ করেছেন।’ এ সময় তিনি আঙুল তুলে দর্শকের সারিতে বসা তাঁর আমন্ত্রিত চার নারীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

ট্রাম্প ক্লিনটনের প্রসঙ্গটি তুলতে পারেন, এমন প্রস্তুতি নিয়েই হিলারি এসেছিলেন। তিনি ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামার কথা উল্লেখ করে বলেন, ওরা (অর্থাৎ ট্রাম্প শিবির) যখন নিচে নামে, আমরা তখন ওপরে থাকি। বিতর্ককক্ষে স্বামী বিল ক্লিনটন ও কন্যা চেলসি উপস্থিত ছিলেন। সম্ভবত নারীঘটিত পুরোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়ানোর জন্যই হিলারি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ অত্যন্ত সংযত ভাষায় উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘নারীদের সম্বন্ধে ট্রাম্প কীভাবে ও কী করেন, এই ভিডিওতে আমরা সে কথাই শুনেছি ও দেখেছি। তাঁর দাবি, ভিডিওতে যাকে দেখা যায় সেটি তাঁর আসল পরিচয় নয়। আমি বলব, যাঁরাই এই ভিডিওটি দেখেছেন, তাঁদের কাছে স্পষ্ট এটিই আসল ট্রাম্প।’ হিলারি বলেন, তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি অনেক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু কখনোই দায়িত্ব পালনে তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। ‘কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁদের সবার চেয়ে ভিন্ন’, তিনি কোনোভাবেই প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য নন।

টাউন হল ধাঁচের এই বিতর্কে হিলারি ও ট্রাম্প মঞ্চের সামনে বসা মোট ৪০ জন নিরপেক্ষ (অর্থাৎ রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট নন) দর্শকদের মুখোমুখি হন। জনমত জরিপ সংস্থা গ্যালপের দায়িত্ব ছিল এই দর্শকদের খুঁজে বের করা। তাঁরা যে প্রশ্ন করেন, সে সবই ছিল তাঁদের নিজেদের। এ ছাড়া ইন্টারনেটের মাধ্যমে মার্কিন নাগরিকদের পাঠানো প্রশ্নও বেছে নেওয়া হয়। এন্ডারসন কুপার ও তাঁর সহসঞ্চালক মার্থার‍্যাডাচ বেশ কয়েকটি অতিরিক্ত প্রশ্ন করেন।

বিতর্কের একপর্যায়ে সম্মুখ সারিতে বসা একজন মুসলিম নারী জানতে চান, ইসলামের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আবহাওয়া দূর করতে তাঁরা কী করবেন। ট্রাম্প ইতিপূর্বে মুসলিমদের আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করেছেন, তবে আগের সপ্তাহে দুই ভাইস প্রেসিডেন্টের বিতর্কে ট্রাম্পের রানিং-মেট মাইক পেন্স সেই প্রস্তাব এখন আর কার্যকর নয় বলে জানিয়েছিলেন। জবাবে ট্রাম্প কিছুটা এলোমেলোভাবে বলেন, বিশ্বের কোন কোন অঞ্চল থেকে কী ধরনের মানুষ আসতে পারবে, তা ‘চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা’ করে দেখা হবে। মার্থার‍্যাডাচ তাঁকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের জন্য চাপ দিলে ট্রাম্প সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আইসিস আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে রয়েছে, সে কথার পুনরাবৃত্তিতে ফিরে যান।

একই প্রশ্নের জবাবে হিলারি অভিযোগ করেন, আমেরিকার মুসলিম ও অন্য নাগরিকদের পরস্পরকে বিভক্ত করে এমন অনেক কথাই ট্রাম্প বলেছেন। যেমন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করেননি বলে ষড়যন্ত্র -ত তিনি দীর্ঘদিন আঁকড়ে ছিলেন। কিন্তু এই মিথ্যাচারের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেননি।

বিতর্কে সিরিয়া প্রসঙ্গটিও উঠে আসে। আগের সপ্তাহে ট্রাম্পের রানিং-মেট মাইক পেন্স আসাদ সরকারের পক্ষে সিরিয়ায় বোমাবর্ষণের জন্য রাশিয়াকে অভিযুক্ত করেছিলেন এবং প্রয়োজনে রাশিয়ার ওপর সামরিক শক্তি প্রয়োগের প্রস্তাব রেখেছিলেন। সে কথা তাঁকে মনে করিয়ে দিলে ট্রাম্প বলেন, এ নিয়ে তাঁদের দুজনের কোনো কথা হয়নি এবং পেন্সের প্রস্তাব তিনি সমর্থন করেন না।

বিতর্কে কে জয়ী?

সিএনএনের গৃহীত এক তাৎক্ষণিক জরিপে ৫৭ শতাংশ দর্শক এই বিতর্কে হিলারি জয়ী হয়েছেন বলে জানান। অন্যদিকে ৩৪ শতাংশ দর্শক ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জয়ী হিসাবে বেছে নেন। ট্রাম্প প্রত্যাশার চেয়ে অনেক ভালো করেছেন। কিন্তু হিলারি প্রত্যাশিত ফল অর্জন করেননি। অধিকাংশ দর্শক সে কথাও উল্লেখ করেন।

অধিকাংশ ভাষ্যকার একমত, এই বিতর্ক ট্রাম্পকে প্রায় মৃত্যুর কাছ থেকে টেনে এনেছে। ট্রাম্প হয়তো নতুন কোনো ভোট নিজের জন্য অর্জন করেননি, কিন্তু অব্যাহত রক্তক্ষরণ সাময়িকভাবে হলেও থামাতে পেরেছেন। তাঁকে বাদ দেওয়ার যে দাবি উঠেছিল, এখন হয়তো তা সাময়িকভাবে হলেও বন্ধ হবে।

হিলারি যে এই বিতর্কে কিঞ্চিৎ ম্রিয়মাণ ছিলেন, কোনো কোনো ভাষ্যকার সেটি পরিকল্পিত বলে ব্যাখ্যা করেছেন। ভিডিও টেপ কেলেঙ্কারির পর বিতর্কে ধরাশায়ী হলে ট্রাম্পকে বাদ দেওয়ার দাবি হয়তো আরও তীব্র হতো। ট্রাম্পের জায়গায় তাঁর রানিং-মেট মাইক পেন্স দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসাবে অবির্ভূত হতেন। বর্তমানে রিপাবলিকান দল যেভাবে বিভক্ত, তা কাটিয়ে উঠে দলের রক্ষণশীল মূল্যবোধের প্রতিনিধি হিসেবে সবাই পেন্সের প্রার্থিতা ঘিরে ঐক্যবদ্ধ হতেন। সেটি হিলারির জন্য মোটেই সুখকর হতো না।

বিতর্কে জয়ী হোন বা না হোন, হিলারি কোনো বড় ধরনের ভুল করেননি। জনমত জরিপে ৫-৭ পয়েন্টে এগিয়ে থাকা হিলারির জন্য সেটিই ছিল সবচেয়ে কার্যকর রণকৌশল।

নারীদের নিয়ে ট্রাম্পের যত মন্তব্য

     ‘আমি সুন্দরী মেয়ে দেখলে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। একদম চুম্বকের মতো, বিন্দুমাত্র অপেক্ষা করি না। তুমি যদি “স্টার” হও, যা খুশি করতে পারো। মেয়েদের গায়ে হাত দিয়ে তাদের কাছে টানতে পারো।’

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031