প্রতিবছর নিজ হাতে পরম আদরে দেবী মায়ের অবয়ব তৈরি করেন। মা মর্ত্যে এলে খুশিতে উজ্জ্বল হয় চোখ, আবার ঠিক বিসর্জনের আগে থেকে সে চোখে অঝোর ধারায় জল নেমেও আসে। তারা প্রতিমা কারিগর। গত এক সপ্তাহজুড়ে শারদীয় উৎসবের আমেজ দেশজুড়ে। এটি বাংলাদেশে বসবাসরত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব।
মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে এ কয়দিন কোন মায়ের অবয়ব কীরকম সে বাছবিচারও করেছেন শিল্পবোদ্ধারা। কিন্তু যারা তৈরি করেন প্রতিমা, শিল্পী হিসেবে তারা মর্যাদা পাননি আজও। কদর কেবল প্রতিমা তৈরি করেন যারা তাদের কাছেই। তার ওপর ভারত থেকে কারিগর আনার প্রবণতাও আছে।
দশমীর সকালে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সাক্ষাৎ মেলে প্রতিমা শিল্পী পরিমল পাল এর সঙ্গে। সকাল থেকে একাধিক মণ্ডপে গেছেন কেবল মায়ের মুখটা শেষবার দেখতে। সবই কি আপনারই বানানো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না। আমরা যারা মায়ের অবয়ব বানাই, তাদের সবার কাছে একই মনে হয়। মা এসেছিলেন, সেই আসার সময়ে আমরা যেমন করে নিমিত্ত হিসেবে কাজ করি, যাওয়ার সময় মনে বড় ব্যাথা অনুভূত হয়। আবার মা আসবেন ঠিকই, কিন্তু এ যাওয়া খুব কাঁদায়।’
প্রতিমা তৈরির প্রস্তুতি নিয়ে কথা হয়ে আরও কয়েকজন কারিগরের সঙ্গে। তারা বলেন, মাটি, খড়, সুতলি ও কাঠ দিয়ে এই প্রতিমা তৈরি করা হয়। কাঠের বদলে কখনও কখনও বাঁশও ব্যবহার হয়ে থাকে। প্রথমে খড় দিয়ে কাঠামোটা তৈরি করা হয়। এ কাঠামোকে সুতলি দিয়ে শক্ত করে পেঁচিয়ে বেঁধে নেওয়া হয়। এরপর কাঠ বাঁশের ফ্রেমের ওপর স্থাপন করা হয়। তারপর এঁটেল মাটি দিয়ে একটা আকৃতি তৈরি করতে হয়। যার ওপর বার বার প্রলেপ দিতে হয়। প্রলেপ দেওয়ার সময় দো-আঁশ মাটির একটু কাজও আছে। এরপর চুন লাগানো, রঙের কাজ হয়। শিল্পী এরপর মনের মাধুরী দিয়ে মায়ের রূপ আঁকেন। তারপর কাপড় আর অলংকার পরানোর কাজ।
বাংলাদেশে এই প্রথম নোয়াখালীতে ৭১ ফুট উচ্চতার প্রতিমা তৈরি করা হয়েছে। আয়োজকদের বক্তব্য, এ বিশালাকৃতির প্রতিমা তৈরির মধ্যে দিয়ে সারাবিশ্বে প্রমাণ করা হবে, এদেশ সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতির দেশ। এ প্রতিমার কারিগর শিল্পী অমল কৃষ্ণ পাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিমা বানাই। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রতিমা।’ আর এটি বানাতে তিনি সহযোগী হিসেবে নিয়েছে ১২ জনকে। মা এলে কেমন লাগে আর যাওয়ার সময়ের অনুভূতি কেমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ষষ্ঠীতে ঘটে তোলার সময় থেকে সবার উৎসব শুরু হলেও আমাদেরতো এক মাস আগেই শুরু হয়। মায়ের অবয়ব তৈরি করি একটু একটু করে আর মনের ভেতরে অনুভূতি তৈরি হয় মাকে লালন করছি। তিনি আরও বলেন, নবমী থেকেই মনের ভেতর কেমন যেন ফাঁকা হয়ে যায়। এতবছর প্রতিমা তৈরি করছি, প্রতিবারই একই অনুভূতি। মা থাকবেন না বলেই আসেন জানি, তবুও মনতো মানে না।
শাখারিবাজারের হরিদাস পাল বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। তারপরেও প্রতিমা তৈরির কাজ থেমে নেই তার। ঠিক কবে থেকে প্রতিমা বানাচ্ছেন মনেও করতে পারেন না। প্রতিমা তৈরিকে শিল্প হিসেবে ভাবেন কিনা বা স্বীকৃতি প্রত্যাশা করেন কিনা এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘বয়স হয়েছে আগের মতো কাজ করতে পারি না। ডিজাইন এঁকে দিই। কারিগররা সেটার ওপরে কাজ করে। কিন্তু এটা ইট কাঠ সিমেন্ট দিয়ে করা কোনও বিষয় না। শিল্পীর মন না থাকলে এ কারিগর হওয়া যায় না। আমাদের সময়তো শেষ, আগামীতে বিষয়গুলো দেখা হবে আশাকরি।’
শাস্ত্রমতে, এবার মা পিতৃগৃহে এসেছিলেন ঘোড়ায় চড়ে। ফিরবেনও ঘোড়ায় চড়ে। মঙ্গলবার সকালে অঞ্জলির মধ্য দিয়ে পূজা শেষ হয়ে সিঁদুর খেলা হয়। শত মন খারাপের মধ্যেও শেষ দিনের মহানন্দ যতটা নেওয়া যায় ভক্তরা একসঙ্গে হয়েছিলেন সেজন্য। কিন্তু মাকে মর্ত্যে আনতে যারা সবচেয়ে বেশি খাটেন, সেই কারিগরদের চোখে সৃষ্টির কান্না, আবারও তাদের হাত ধরে মর্ত্যে আসবেন মা এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ঘরে ফিরে যান।