রুকসানা ১৩ বছরের মেয়েশিশু। কুড়িগ্রামে বাড়ি। স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে বাবা বিয়ে ঠিক করেন রুকসানার। স্বামী ৩০ বছরের রবিউল। পেশায় ট্রাক ড্রাইভার। বিয়ের আগে রুকসানার বন্ধুরা মিলে কোনোভাবেই এ বিয়ে হতে দেবে না জানালে, রুকসানার বাবা তাকে নিয়ে ঢাকায় আসেন এবং প্রায় অবরুদ্ধ অবস্থায় বিয়ে হয় তার।
রিমির বয়স ১৪। মা ঢাকায় গৃহস্থালি কাজ করেন। মেয়েও এধরনের কাজ করুক, তিনি তা চান না। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া রিমিকে তিনি কাঠমিস্ত্রির সঙ্গে বিয়ে দিতে চান।অস্বীকৃতি জানালে রিমির বিধবা মা তাকে মানসিকভাবে দুর্বল করতে নানাবিধ কথা বলেন।এক সময় রিমি রাজি হয়। বিয়ে হওয়ার পর রিমি জানতে পারে, তার স্বামীর আগে আরও দুই স্ত্রী রয়েছে।
আজ (মঙ্গলবার) আন্তর্জাতিক মেয়েশিশু দিবস।গত দু’দশকের চেষ্টায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার কমানো সম্ভব হয়নি। এমনকি ছেলেদের তুলনায় মেয়েশিশুদের সারাজীবনে বেশি কাজ করতে হয়,যা তার সুস্বাস্থ্যের অন্তরায়। এমন পরিস্থিতিতে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সামাজিক এই অবস্থান বড় বাধা বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি। বাংলাদেশে ১৮ শতাংশ মেয়ের ১৫ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে হয়। ১৮ বছর বয়সের মধ্যে ৫২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়। সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্য অনুসারে, ১০ বছর বয়সী কন্যাশিশুদের অনেক বেশি বয়সী পুরুষদের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। আফগানিস্তান, ইয়েমেন, ভারত, সোমালিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের বিয়ের ঘটনা ঘটছে। ইউনিসেফ’র ২০১৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে বাল্য বিবাহের হার বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বাল্য বিবাহের হার বিবেচনায় বিশ্ব তালিকার প্রথমে আছে আফ্রিকার দেশ নাইজার এবং এর ঠিক পরেই বাংলাদেশ।
প্রতিবছর ১১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালন করা হয়। এ দিবসকে সামনে রেখে সেভ দ্য চিলড্রেন নতুন এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, কম বয়সে বিয়ের মধ্য দিয়েই মেয়েদের জীবনের নানান সমস্যার সূত্রপাত। এই সংকটের চক্র মেয়েদের জীবনজুড়ে চলতে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহবুবা নাসরিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাল্যবিবাহের মাধ্যমে মেয়েরা পারমানেন্টলি ক্ষতির চক্রে ঢুকে পড়ে। যা মেয়েদের শিক্ষা, উন্নয়ন ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। যে মেয়েদের শিশু বয়সে বিয়ে হয়, তারা স্কুলে যেতে পারে না। ফলে তাদের নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার প্রাথমিক পাঠ হয় না। এবং সে একজন বলিষ্ঠ মা হয়ে তার সন্তানকে মানুষ করার ক্ষমতা অর্জন করে না ।’শিশু অধিকার নেত্রী ওয়াহিদা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাল্যবিবাহ যে হারে কমার কথা ছিল, ততটা কমানো সম্ভব হয়নি।আমরা এখনও বলার মতো জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। আমাদের এখানে মেয়ে শিশুদের পড়ালেখা অব্যাহত রাখতে নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সমাজের মূল জায়গায় সচেতনতা তৈরির কাজটি হচ্ছে না। আমরা ধরেই নিচ্ছি, এরা পরিবারের জন্য বোঝা এবং একটু বয়স হলে আর বিয়ে হবে না। এমনকি সমাজে চলমান অস্থিরতা ও বখাটেদের উৎপাত ঠেকানো না গেলে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না।’
মেয়ে শিশুর গৃহস্থালি কর্মঘণ্টা নিয়েও শঙ্কা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘একজন মেয়ে কমবেশি ৬ বছর বয়স থেকেই নানা কাজ করতে শুরু করে। ছেলেশিশুদের এই বাড়তি গৃহস্থালি কাজে হাত দিতে হয় না। এর ফলে মেয়েশিশুর জীবনের একটা বড় অংশ এমন কাজে যায়, যার মূল্যমান নির্ধারিত হয়নি। এতে তার কনফিডেন্স বাড়ে না এবং অভিভাবকরা যখন তাকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত মনে করেন, তখন সে প্রতিরোধ করতে পারে না ।’