আগে লোকে চোখের আড়ালে দুর্নীতি করতো।বাংলাদেশের সমাজে দুর্নীতি এখন চোখে দেখা যায়। সেই সম্পদ ভোগ করতো আড়ালে-আবডালে। হালে সেই চোখের পর্দা আর মানুষের নেই। রাস্তা-ঘাট, অফিস, শিক্ষাঙ্গন, স্টেডিয়াম; পাড়া যেখানেই যান না কেন, দুর্নীতির ঘটনা চোখে পড়বেই। আপনি, আমি প্রত্যেকেই প্রতিদিন দুর্নীতির শিকার হই কিংবা দুর্নীতিতে অংশ নেই। দুর্নীতির এক অন্য অর্থও তৈরি হয়েছে। টাকা দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়াকে অনেকে এখন আর দুর্নীতিও বলে না। বলে সার্ভিস চার্জ কিংবা স্পিড মানি। আমাদের অর্থমন্ত্রী মহোদয়ও একবার এই স্পিড মানির প্রশংসা করেছিলেন।
যেভাবেই হোক আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র এখন আর দুর্নীতি করতে লজ্জাবোধ করে না। দুর্নীতির ভোগ পালনে সমাজ বা রাষ্ট্রের চক্ষুলজ্জাও আর নেই। দুর্নীতি করার পেছনে মানুষের নানান লজিক থাকে। ব্যক্তি মানুষ, সমষ্টি মানুষ নানা যুক্তি দেখিয়েই এই দুর্নীতির কাজে নিয়োজিত থাকে। আবার দুর্নীতির গতিধারা উঁচু থেকে নিচুতে স্বাভাবিক গতিতে প্রবহমান। বড় পদে যিনি আছেন, তিনি যখন দুর্নীতি করেন, তার কথা বা কাজে যখন দুর্নীতির ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা পায়- তখন নিচে যারা থাকেন, তারা দুর্নীতি করতে উৎসাহিত হন। দুর্নীতিকেই তারা অবশ্য কর্তব্য বলে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হন। বাংলাদেশের সমাজে দুর্নীতি এখন সেই অবশ্য কতর্ব্য বিষয় বলে এটাকে আর খারাপ বা হীন বলে মনে করে না। বরং যে দুর্নীতি করে মানুষ তাকে ক্ষমতাবান বলেই ধরে নেয়।
দুই.
মানুষ দুর্নীতি হতে দেখে। দুর্নীতির কথা শোনে। যারা সাধারণ মানুষ, যারা ক্ষমতা কাঠামোর বাইরের মানুষ, যাদের সংখ্যাই বেশি- নিত্যদিনের কাজে তারা দুর্নীতির শিকার হন। বাধ্য হয়ে দুর্নীতিতে অংশও নেন তারা। তারা মনে মনে স্বপ্ন দেখেন এমন একজন কেউ যদি কখনও আসত, যে শক্ত হাতে দুর্নীতির রশিটা টেনে ধরতো! এসব স্বপ্ন কল্পনা তারা দেখেন, তাদের চোখের সামনে কেউ নেই বলেই। মানুষের হাতে দুর্নীতি বাড়ে। কমে না বলে তারা শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের কাছে হাত পাতেন। তারা ভাবেন, শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর এই দুর্নীতিবাজদের বিচার করবেন। সে কারণেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেন এ রকম কোনও শক্তিমান মানুষ যদি তারা পান, কখনও দেখেন, অথবা কখনও শোনেন এ রকম কারও কথা যিনি দুর্নীতি বিরোধী লড়াইয়ে আপসহীন- তার ক্ষমতা যাই হোক না কেন তারা তার প্রতিই মানুষ ভরসা করতে থাকেন। তাই যখন রাজনীতিতে দুর্দিন আসে, আসে সামরিক শাসন কিংবা ১/১১-এর মতো ছদ্মবেশী সামরিক শাসন তখন সেই শাসকরা রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির বিচারের দাবি তোলেন। সে দাবি জনপ্রিয়তাও পায়। কিন্তু যারা বিচার করেন এই দুর্বিনীতি দুর্নীতির, তারা নিজেরা সুনীতির মানুষ নন বলেই সেই বিচারও সুবিচার হয় না। মানুষের হৃদয়েও ঠাঁই পান না এইসব বকধার্মিক দুর্নীতির বিচারকেরা। ফলে রাজনীতির দুর্দিনে নতুন শাসকদের প্রথম ক’দিন দুর্নীতিবিরোধী আওয়াজ ওঠে বটে কিন্তু সেই আওয়াজ মানুষের বাহ্বা পায় না। তবে মানুষের আফসোস থাকে। কেননমানুষ প্রকৃত দুর্নীতিবাজদের বিচার দেখতে চায়।
তিন.
দুর্নীতির বিচারের জন্য তৈরি হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন ওরফে দুদক। দুদকের নামের মধ্যে একটা জোরের ব্যাপার আছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় দুদক দুর্নীতি দমনে কাজ করতে পারবে। যদিও দুদক কখনোই সেই কাজটি করেনি বা করতে পারেনি। কেননা অতীতে দুদক সরকারের আজ্ঞাবহ হয়েছে। সরকার যাকে যেভাবে দমন করতে চেয়েছে, দুদক তখন তাকে নিধন করতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সরকার নির্দেশিত শত্রুকে দমনের কাজে দুদকের সাফল্য আছে বলা যায়। অতীতে ১/১১-এর সরকারের সময় দুদক সেই ভাবমূর্তি সার্থক ভাবে গড়ে তুলতে পেরেছে। বর্তমান সরকারের সময়েও দুদক সেই ভাবমূর্তি থেকে বেরুতে পারেনি।
কিন্তু হালে দুদক একটু নড়েচড়ে বসেছে। সম্প্রতি সময়ে দুদক বৃহত্তরভাবে আলোচনায় এসেছে দুটি কারণে।
এক. দুদকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এমন একজন আমলাকে যিনি সৎ এবং সক্রিয় আমলা হিসাবে পরিচিত। দুদকের ভেতরে প্রশাসনিক কাঠামোর ভেতরে এরকম একজন পরীক্ষিত ও সৎ আমলার নিয়োগ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এই আমলা অতীতে পরিবেশ অধিদফতর, মিল্ক ভিটাসহ ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিতে চাকরিকালীন সময়ে তার সাহসী, সৎ ও অন্যায়ের কাছে নত না হওয়ার যে উদাহরণ রেখে এসেছেন, সেরকম একজন মানুষকে দুদকের আমলাচক্রে বসানো হলো কেন? তাহলে দুদক কি সত্যিই সক্রিয় হতে চায়? সক্রিয় হলে কাদের দুর্নীতি নিয়ে তারা কাজ করতে চায়। দুদকের এই কাজের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকছে কারা?
দুই. ইতোমধ্যে দুদক দুর্নীতির অভিযোগে সামরিক-বেসামরিক মাঝারি মানের আমলা, ব্যাংকের মাঝারি মানের কর্মকর্তা, সরকারি বেশ কিছু দফতরের মাঝারি মানের প্রকৌশলীসহ বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের দুর্নীতির পর সেখানেও হাত দিয়ে এই মাঝারি মানের কর্তারা গ্রেফতার হলেও বড় বড় রুই কাতলারা অধরা থাকছেন। তাই প্রশ্ন উঠছে দুদকের এই সাম্প্রতিক তৎপরতা নিয়ে। এমনকি সরকারের একজন মন্ত্রীও দুদকের বর্তমান এই অপারেশন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে সরকারের গণপূর্তমন্ত্রী বলেই ফেলেছেন, ‘দুদক বিরক্ত করলে অসুবিধা আছে’। তিনি অভিযোগ করেছেন দুদক রাজউকে গিয়ে নানা সুবিধা চেয়ে না পেয়ে যার-তার ফাইল টানছে। অবশ্য এই অভিযোগ নাকচ করে দুদকের বর্তমান চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করাই দুদকের কাজ।’
চার.
সঠিক কাজ কোনটি, সেটির একটা জনধারণা আছে। দুদকের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সেই জনধারণার প্রতি মন দেওয়া। দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা জনধারণায় দুর্নীতি করে বুক ফুলে ঘুরে বেড়াবে আর চুনোপুটিদের ধরে দুদক শক্তি দেখাবে সেটা দুদকের মান বাড়াবে না। আবার এটাও ঠিক যাদের আমরা চুনোপুটি বলছি তাদের সংখ্যাও দেশে কম নয়। এই চুনোপুটিদের দুর্নীতির অংকও কম নয়। সুতরাং রাঘব-বোয়াল-সিংহ মানের দুর্নীতিবাজদের কবে ধরতে পারব, এই অপেক্ষায় দুদক যদি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে তবে সেটাও কাজের কথা না। দুদককে সবদিকেই হাত পা চালাতে হবে। বড় দুর্নীতিবাজদের যেমন অধরা রাখা যাবে না তেমনি চুনোপুটিদেরও ছাড়া যাবে না।
পুনশ্চ: লেখাটা শেষ করি একটা পুরনো জোকস দিয়ে।
ভারতে এক সময় বিতর্ক উঠেছিল যে, কোন রাজ্য সরকার দুর্নীতিতে শীর্ষে? সে বিতর্কের নিষ্পত্তি সম্পর্কে একটি কাহিনির সৃষ্টি হয়।
ছয় বছর আগে কেরালার এক এমপি চন্ডিগড়ে এসে তার এক পাঞ্জাবি মন্ত্রী বন্ধুর বাসভবনে উঠলেন। পুরনো বন্ধুর প্রাচুর্য দেখে তিনি জানতে চাইলেন, কী করে তোমার পক্ষে এত বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া সম্ভব হলো?
‘তুমি কি আসলেই ব্যাপারটা জানতে আগ্রহী?’
‘নিশ্চয়ই বাড়তি জ্ঞান অবশ্যই আমাকে সাহায্য করবে।’
‘তাহলে আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করো। তোমাকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করব।’
পরদিন মন্ত্রী মহোদয় তার ব্যক্তিগত গাড়িতে এমপি বন্ধুকে উঠিয়ে হাইওয়ে দিয়ে কয়েক মাইল দূরে গিয়ে থামলেন। দু’জন গাড়ি থেকে নামলেন এবং মন্ত্রী দূরে উপত্যকার দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললেন, ‘তুমি কি ওখানে একটি ব্রিজ দেখতে পাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ’। এমপি উত্তর দিলেন। ‘ওই ব্রিজের নির্মাণ ব্যয়ের অর্ধেক টাকা আমার পকেটে এসেছে।’
চার বছর পর পাঞ্জাবি তার মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। তিনি ত্রিবেন্দামে গিয়ে তার পুরনো বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন, যিনি তখন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাঞ্জাবি বন্ধু বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, তুমি আমাকেও হার মানিয়ে দিয়েছ। ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি, ইতালিয়ান মার্বেল, মার্সিডিজ! কী করে এসব সম্ভব হলো?
মন্ত্রী বললেন, ‘তোমাকে আগামীকাল সব বলব।’
পরদিন সকালে মন্ত্রী তাকে হাইওয়ে দিয়ে নিয়ে গেলেন এবং এক স্থানে থামার পর দু’জন গাড়ি থেকে নামলেন। মন্ত্রী উপত্যকার দিকে আঙুল নির্দেশ করলেন এবং বললেন, ‘ওখানে কি একটা ব্রিজ দেখতে পাচ্ছ?’
‘না, আমি তো কোনও ব্রিজ দেখতে পাচ্ছি না।’ পাঞ্জাবি উত্তর দিল।
‘ঠিকই বলেছ।’ মন্ত্রী বললেন।
‘ব্রিজের পুরো অর্থই আমার পকেটে এসেছে।’