বিশ্বের ১৯টি দেশে অক্টোবরের ৫ তারিখ ‘টিচার্স ডে’ পালিত হয়।আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। দেশগুলো হলো—কানাডা, জার্মানি, আজারবাইজান, ইস্তোনিয়া, লিথোনিয়া, ম্যাকেডোনিয়া, মালদ্বীপ, নেদারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, রাশিয়া, রোমানিয়া, সার্বিয়া, ইংল্যান্ড, মাউরেটিয়াস, মলদোভা, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, কুয়েত ও কাতার।
বিশ্বের অন্য ১১টি দেশে ২৮ ফেব্রুয়ারি দিনটিতে বিশ্ব শিক্ষক দিবস চালু। দেশগুলো হলো মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া, লিবিয়া, মিসর, জর্ডান, সৌদি আরব, ইয়েমেন, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব-আমিরাত ও ওমান। যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৫৫১ বছর পূর্বে চীন দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রখ্যাত দার্শনিক ও শিক্ষক কনফুসিয়াস। তাঁর জন্মদিন ২৮ সেপ্টেম্বর ধরে নিয়ে বিশ্বে প্রথম চীন দেশে ওই দিনটিকে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হয়। পরে পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে ওই দিনটিকে শিক্ষক দিবস হিসেবে বরণ করে নেয়।
সমাজে শিক্ষকের গুরুত্ব যথার্থভাবে মূল্যায়ন করে জাতিসংঘের শাখা সংগঠন ইউনেস্কো ১৯৯৩ সাল থেকে ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবস হিসেবে বিশ্বের সর্বত্র প্রতি বছর উদ্যাপন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর থেকে জাতিসংঘের প্রতিটি দেশে দিবসটি উদযাপন করা হয়। এটি দেশ-বিদেশে ‘শিক্ষক’ পেশাজীবীদের জন্য সেরা সম্মান। পরবর্তী প্রজন্মও যাতে কার্যকরী ও যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে এই দিনটি পালন করে সেটাও উদ্দেশ্য। এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল মনে করে, জাতীয় স্তরে সমগ্র বিশ্বেই একটি বিশেষ দিনকে স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি—যেটি সমাজ-সংস্কার-শিক্ষায় শিক্ষকদের উপযুক্ত মান্যতা দান করার যোগ্য দিন। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘শিক্ষকের মূল্যায়ন, মর্যাদার উন্নয়ন’।
প্রাচীন ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যাবে গ্রিস দেশ এক সময়ে ছিল বিশ্বের সর্বাধিক উন্নত দেশ। ওই যুগে গ্রিসে শিশুদের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হতো শিক্ষকদের ওপর। ‘পেডাগগ’ অর্থাৎ শিশুদের নেতা শব্দটি গ্রিকরাই উদ্ভাবন করে ও তার যথাযথ প্রয়োগের ব্যবস্থা করে। ওই দেশের অগ্রগতির ক্ষেত্রে ওই ব্যবস্থা সর্বাধিক সহায়কের ভূমিকা পালন করেছিল বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
অ্যারিস্টটল সেই কারণেই বলেছেন—‘যাঁরা শিশুদের শিক্ষাদানে ব্রতী তাঁরা অবিভাবকদের থেকেও অধিক সম্মাননীয়। পিতামাতা আমাদের জীবনদান করেন ঠিকই। শিক্ষকরা সেই জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন।’
সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী লুনাচারস্কি শিক্ষকদের সম্পর্কে এক ভাষণে বলেছিলেন ‘শিক্ষক হলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি নূতন প্রজন্মের কাছে যুগ-যুগান্তরে সঞ্চিত যাবতীয় মূল্যবান সাফল্য হস্তান্তরিত করবেন, কিন্তু কুসংস্কার, দোষ ও অশুভকে ওদের হাতে তুলে দেবেন না। এটাই হলো শিক্ষকদের গুরুত্বের মাপকাঠি। মনে রাখা প্রয়োজন, শুধু তাঁদের দিয়েই আমরা সুস্থ কুঁড়িগুলিকে লালন করতে পারি।’
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে অনেক মূল্যবান অভিমত প্রকাশ করে গেছেন—‘শিক্ষাবিধি’ প্রবন্ধে তাঁর অনেক উদাহরণ আছে। ভারতের ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণের প্রয়াণে, রবীন্দ্রনাথের লেখায় ধ্বনিত হয়েছিল বেদনার সুর, ‘সেই তো বসন্ত ফিরে এল, হৃদয়ের বসন্ত কোথায় হায় রে। সব মরুময়, মলয়-অনিল এসে কেঁদে শেষে ফিরে চলে যায় হায়রে।’ প্রতি বছর যখনই ৫ সেপ্টেম্বর আসে, তখনই ভারতের সব শিক্ষা-হিতৈষী মানুষের হৃদয় কন্দরে এমনই মর্মবেদনা জাগ্রত হয়। শোনা যায়, তাঁর প্রিয় ছাত্র ও অধ্যাপক বন্ধুবান্ধব, তাঁর জন্মদিন পালন করতে আগ্রহ প্রকাশ করলে— রাধাকৃষ্ণণ তাঁদের বলেছিলেন, ‘আমার জন্মদিন পৃথকভাবে পালন না করে আমি গর্বিত হবো, দিনটি যদি দেশের সমস্ত শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে পালন করা হয়।’
তাইতো এই মহান শিক্ষাব্রতী সম্পর্কে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, ‘‘He has served his nation in many capacities. but above all he is a great teacher from whom all of us have learnt much and will continue to learn.’’
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে শিক্ষক সংগঠনগুলো নানা কর্মসূচিও হাতে নিয়েছে। আলোচনা সভা ও শোভাযাত্রা, নানা আয়োজনে দিবসটি পালিত হচ্ছে। সমাজের সার্বিক অগ্রগমনে এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ যারা করছে এটুকু আয়োজন কি তাদের জন্য যথেষ্ট। এটাই কি তবে দিবসটির তাৎপর? আমারা সবাই জানি সমাজের সর্বত্র শিক্ষকদের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষালয়ে যে মানবসম্পদ তৈরি করা হয়, সেখানে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা অতুলনীয়। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে আজ এই গুরুত্বপূর্ণ দিবসে বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, কিংবা শিক্ষা ও শিক্ষক নিয়ে বাংলাদেশের ভাবনা কি সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার সময় এসেছে। সময় এসেছে বললে নিশ্চিত ভুল হবে, বলতে হয় সময় পার হয়ে যাচ্ছে। ‘সময় গেলে যে সাধন হবে না’ লালনের উক্তি যে বাঙালি জীবনে ফলে যাচ্ছে তার প্রমাণ হলো, মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশা বর্জন। প্রতি বছর ভালো ছাত্ররা পাস করে ভালো সুযোগ সুবিধার জন্য অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। ফলে এ পেশায় ঢুকে পড়ছে কম মেধাবী সম্পন্নরা। যারা কি না পেছনের বেঞ্চের শিক্ষার্থী ছিল। ফলে দিনের পর দিন আমদের শিক্ষার হার বাড়লেও মান পিছিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকরা তাদের দাবি দাওয়াগুলো বিভিন্ন সময় উপস্থাপন করে আসছে। কয়টা দাবি আমরা তাদের পূরণ করতে পারছি। সামান্য কিছু বেতন বাড়িয়ে আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি! তাদের দাবিগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে পেশা হিসেবে বর্তমানে এটা কতটা অবহেলিত। আমরা এসব বুঝি না যে তা না। সবাই এসব বুঝি, চুপ থাকি। চুপ থাকাটা এখন আমাদের ধর্মে পরিণত হচ্ছে। তবে একটা কথা দার্শনিকরা বলে থাকেন, মৃত্যুর অপর নাম নির্জনতা। সব কিছুতেই এমন নির্জন থাকলে জাতি হিসেবে খুব শিগগির আমাদের মৃত্যু ঘটবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, নাট্যকর্মী