বিশ্বব্যাপী নারীরা নিজেদের অধিকার আদায়ে অত্যন্ত সচেতন শিরোনামের মৌলিক এই প্রশ্নটা এমন এক সময়ে উঠল যখন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুরুষের সাথে সমঅধিকার ও সমান পারিশ্রমিক আদায়ে সচেষ্ট তারা। কিন্তু মডেলিং সম্ভবত খুব বিরল একটি পেশা, যেখানে নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পান। এ পেশায় নারী পুরুষের ব্যাবধানটা অনেকের কাছেই এখন দৃষ্টিকটু লাগছে। একজন নারী মডেল একটি মাত্র ফ্যাশন শো থেকে যে পরিমাণ আয় করতে পারছেন, একজন পুরুষ মডেল সারা মাসেও ততোটা আয় করতে পারছেন না বলে অভিযোগ অাছে। প্রশ্ন হচ্ছে এ পেশায় নারী পুরুষের বৈষম্য কেন?
সিন্ডি ক্রফোর্ডের মতো প্রথম সারির মডেলের ক্যারিয়ার যার হাত ধরে গড়ে উঠেছে, সেই এলিজাবেথ রোজ সম্প্রতি বলেছেন, ‘মডেলিং হচ্ছে দুনিয়ার একমাত্র পেশা যেখানে নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি আয় করে’। এটিকে পুরুষের প্রতি অন্যায় হিসেবেও মনে করেন এলিজাবেথ রোজ।
অমিত রঞ্জন ভারতের একজন মডেল। গত ১১ বছর ধরে মডেলিং করা এই মডেল বলেন, বলিউড হচ্ছে পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিক। এখানে ৫০ বছর বয়স্ক কোনো অভিনেতাও প্রেমিকের চরিত্রে অভিনয় করতে পারে। কিন্তু ভারতের মডেলিং ইন্ডাস্ট্রি নারী কেন্দ্রিক। যেকোনো ফ্যাশন শোতে চার পাঁচজন পুরুষ মডেলের সাথে ১৬-২০ জন নারী মডেল থাকে। সমস্যা হচ্ছে এ ইন্ডাস্ট্রিতে পুরুষের চাহিদা কম, কিন্তু যোগান অনেক বেশি। প্রতি মাসেই অনেক তরুণ টপ মডেল হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এ পেশায় ঢুকে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এ পেশায় ছেলেদের আসলে তেমন কোনো কাজ নেই।
এমন অসাম্যতার কারণ সম্পর্কে রঞ্জন বলেন, ‘ভারতে নারীদের পোশাকের ডিজাইনাররাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে পুরুষের পোশাক ডিজাইনারদের বাজারে তেমন আধিপত্য নেই। ফলে ডিজাইনাররা স্বাভাবিকভাবেই মেয়েদের পোশাক বেশি ডিজাইন করেন। যার কারণে ফ্যাশন শোগুলোতেও ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের উপস্থিতিই বেশি।
রঞ্জন বলেন, ‘তারপরও এ পেশায় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য ছেলেরা মুখিয়ে আছে। একটি ফ্যাশন শোতে অংশ নেয়ার জন্য ছেলেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার হিড়িক পড়ে যায়। অনেক ছেলে মডেলকে শো শুরুর আগে তার পারিশ্রমিক কমানোর জন্য চাপ দেয়া হয়। এমন-কি র্যাম্পে বিনা পারিশ্রমিকে হাঁটার মতো তরুণেরও কোনো অভাব নেই।’
চার বছর ধরে মডেলিং করে কিছুটা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন আরেকজন মডেল রুহউল্লাহ গাজী। তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য তরুণ মডেলদের এ ধরনের প্রবণতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের মতো যারা অনেক বছর ধরে এ পেশার সাথে আছি। এত বছর ধরে এ পেশায় থেকে এখন তো আমরা অল্প টাকায় শো করতে পারি না।’
রুহউল্লাহ আরও বলেন, ‘পারিশ্রমিক কমাতে রাজি না হওয়ার কারণে আমাকে অনেক বড় বড় শো মিস করতে হয়েছে। ফ্যাশন শো’র আয়োজকরা চার বছর আগে আমাকে যে পরিমাণ পারিশ্রমিক দিত, এখনো তা-ই দিতে চায়। আমি জানি না আয়োজকরা কেন বুঝতে চায় না যে সময়ের সাথে সাথে মডেলদের অভিজ্ঞতা ও খরচ দুটোই বাড়ে।’
কার কেমন আয় (ভারতের প্রেক্ষাপটে)
ভারতে এজন উদীয়মান নারী মডেল প্রতি শোতে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার রুপি আয় করতে পারেন। কিন্তু একই অবস্থানের একজন পুরুষ মডেল পান ৬ থেকে ৮ হাজার রুপি। অার একজন প্রতিষ্ঠিত নারী মডেল শো প্রতি ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পেলে প্রতিষ্ঠিত একজন পুরুষ মডেল পান সর্বোচ্চ ৩০ হাজার রুপি।
অধিকাংশ পুরুষ মডেলই মনে করেন এ বৈষম্যের মূল কারণ হচ্ছে ডিজাইনাররা, যারা পুরুষ মডেলদের সাথে প্রতিনিয়ত পারিশ্রমিক নিয়ে দর কষাকষি করেন। সাধারণত মডেলরাই তাদের পারিশ্রমিক ঠিক করেন। কিন্তু ডিজাইনাররা সবসময়ই ‘বাজেট সঙ্কটের’ অজুহাত দেখিয়ে তাদেরকে ছাড় দেওয়ার ‘অনুরোধ’ করেন।
সিদ্ধার্থ রাওয়াল নামের একজন মডেল বলেন, ‘এ অনুরোধ আসলে এক ধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকি। কারণ পুরুষ মডেল তার পারিশ্রমিক না কমালে ডিজাইনার সহজেই আরেকজন বিকল্প মডেল পেয়ে যাবেন, যিনি তার চেয়ে কম পারিশ্রমিকেও কাজ করতে রাজি। কারণ পুরুষ মডেলের কোনো অভাব নেই। ফলে অধিকাংশ মডেলই কাজ না পাওয়ার ভয়ে অল্প পারিশ্রমিকেই কাজ করতে রাজি হতে বাধ্য হন।’
ফ্যাশন শো থেকে ডিজাইনাররা যে অর্থ আয় করেন, তা তারা পোশাকের উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণের মতো খাতে খরচ করেন। তাহলে কেন তারা মডেলদের প্রাপ্য পারিশ্রমিক দেবে না, যেখানে মডেলরাই একটি ফ্যাশন শো’র প্রাণ?-এ প্রশ্ন রুহউল্লাহ গাজীর। তিনি আরও বলেন, মানুষ এখন ভেবেই নিয়েছে যে প্রতিষ্ঠিত মডেলরা পারিশ্রমিকের জন্য শো না করলেও তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। একজন না হলে আরেকজন আছে। বরং বিকল্পজন আরও কম পারিশ্রমিকেই কাজ করতে রাজি।
রুহইল্লাহ গাজী মনে করেন, ডিজাইনারদের উচিত পুরুষ মডেলদের তাদের প্রাপ্য সম্মান ও পারিশ্রমিক দেওয়া, কারণ একটি সফল শো’র জন্য সবাইকে সমান পরিশ্রম করতে হয়।
এমন অবস্থায় কয়েজন পুরুষ মডেল একটি আলাদা কমিশনের দাবি করেছেন যেটি মডেলদের অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী পারিশ্রমিক নির্ধারণ করবে। নারী মডেলদের সাথে এ বৈষম্য এখন পুরুষ মডেলদের ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
রঞ্জন যেমন মনে করেন, তাদের ক্যারিয়ার বাঁচাতে হলে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার সমান পারিশ্রমিক হওয়া উচিত। নতুন ও আগ্রহী মডেলদের জন্য রঞ্জনের পরামর্শ হচ্ছে, পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে তারপরই এ পেশায় আসা উচিত। আর শুধু মডেলিং করার জন্য কারও চাকরি ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। এ পেশায় কিছুটা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরই শুধু পুরো সময় মডেলিংয়ের পেছনে দেয়া উচিত। নইলে দুর্দশা আরো বাড়বে। বাইরে থেকে এটিকে যতটা ঝাঁকঝমকই দেখা যাক না কেন, ভেতরের পরিবেশ অন্যরকম। এটা এমন এক পেশা যেখানে মডেলদের কারণে অনেক অর্থ আয় হয়, কিন্তু মডেলরা সে অর্থের ভাগ খুব কমই পায়।
তবে ডিজাইনার স্বতী ভিজয়ভার্গি কিন্তু অনেক আশাবাদী। তিনি বলেন, এখন অনেক ডিজাইনার ছেলেদের আকর্ষণীয় ডিজাইনের পোষাক বাজারে আনছেন। দিন দিন র্যাম্পে ছেলেদের উপস্থিতি বাড়ছে বলেও মনে করেন তিনি। এ ডিজাইনার মনে করেন, পুরুষ মডেলদের এখন যেসব সঙ্কট আছে, সময়ের সাথে সাথে সেসব সঙ্কট আর থাকবে না।