অমল চন্দ্র গোলদার ১০ বছর বয়সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়ার । এরপর আর বাড়ি ফেরেননি উপজেলার উত্তর মিঠাখালী গ্রামের নীলকান্ত গোলদার ও শৈলবালা গোলদার দম্পতির ছোট ছেলে। বহু সন্ধানের পর তার খবর না পেয়ে ছেলেকে মৃত ভেবেই টানা ৩০টি বছর কেটে গেছে মায়ের জীবনে। হঠাৎ সন্তানহারা বৃদ্ধা মায়ের কাছে খবর আসে তার হারানো ছেলে বেঁচে আছে। আর এ খবর মেলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক-এর কল্যাণে। অশীতিপর শৈলবালার ঘরে বইছে এখন সুখের কান্না।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া শিশুটির পরিবর্তন হয়েছে সেই সঙ্গে বদলে গেছে দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি। তারপরও বদলে যায়নি মাটির টান, গর্ভধারিণী মায়ের প্রতি মমত্ববোধ। এ কারণেই হয়তো কয়েক হাজার মাইল দূরে থেকেও মায়ের খোঁজ পেলো হতভাগ্য সন্তান। এ যেন অন্য আনন্দ, অন্য অনুভূতি।
মঠবাড়িয়ার অমল কান্তি গোলদার টানা ৩০ বছর ধরে নিখোঁজ থাকার পর গত শুক্রবার তার পরিবার জানতে পারেন ১০ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া অমল এখন কাতার প্রবাসী। এই দীর্ঘ সময়ে পরিবার স্বজন ছেড়ে শিশু অমল নিদারুণ লড়াইয়ে এখন পরিণত মানুষ। তবে স্মৃতি থেকে হারিয়ে গিয়েছিল তার পরিবার, ঘরবাড়ি আর স্বদেশ ভূমি।
স্থানীয়দের সূত্রে জানা গেছে, মঠবাড়িয়া উপজেলার উত্তর মিঠাখালী গ্রামের নীলকান্ত গোলদারের তিন ছেলের মধ্যে সবার ছোট অমল গোলদার পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৮৬ সালে নিখোঁজ হয়। এরপর আর তাকে তার পরিবার খুঁজে পায়নি। শিশু অমল ওই সময় পাচারকারীদের কবলে পড়ে প্রথমে ভারতে চলে যায়। গত নয় বছর ধরে এখন সে কাতার প্রবাসী। কাতার প্রবাসী কুষ্টিয়ার সবুর আলী নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে মঠবাড়িয়ার জামান আবিরের সঙ্গে ফেসবুকে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তাদের দুজনের মধ্যে মেসেজ আদান-প্রদানও হয়। এক সময় সবুর আলী তাকে জানান, মঠবাড়িয়ার একটি ছেলে কাতারে আছে। তার নাম অমল গোলদার। তবে সে ১০ বছর বয়সে হারিয়ে গিয়েছিল। ঘরবাড়ি আর পরিবারের বৃত্তান্ত কিছুই সে নিশ্চিত করে বলতে পারে না।
এরপর জামান আবির মঠবাড়িয়ায় খুঁজতে থাকে গোলদার পরিবার এবং একসময় কাতারপ্রবাসী অমলের পরিবারের খোঁজে। গত শুক্রবার মঠবাড়িয়ার উত্তর মিঠাখালী গ্রামের নীলকান্ত গোলদারের বাড়িতে গিয়ে অমলের বিষয়ে তথ্য দিলে তার পরিবার বিষয়টি নিশ্চিত করে। পরে মা শৈলবালা গোলদারের সঙ্গে ছেলে অমলের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আবেগঘন কথোপকথন হয়। এভাবে ৩০ বছর পর অমল তার পরিবারের সন্ধান পায়। মায়ের কান্নায় নিজেকেও স্বাভাবিক রাখতে পারেনি কাতার প্রবাসী অমল গোলদার। মা মা বলে বারবার চিৎকার করেন হারানো মাকে কাছে পাওয়ার জন্য। অমলের মা ও পরিবারের সকলের কান্নায় পাড়া প্রতিবেশীরা ভিড় করলে সেখানে এক হৃদয় নাড়িয়ে দেয়ার পরিবেশের অবতারণা ঘটে। হারিয়ে যাওয়া ছেলে বেঁচে থাকার আনন্দে মা শৈলবালার কান্নায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত অনেকেরই নীরবে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়েছে।
প্রবাসী অমল গোলদার জানান, ছোট বেলায় সে খুব ডানপিটে আর দুরন্ত ছিল। ১০ বছর বয়সে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তুষখালী লঞ্চঘাটে এসে একটি লঞ্চে চড়ে। এরপর সে হারিয়ে যায়। পরে পাচারকারীদের কবলে পড়ে ভারতে চলে যায়। সেখানে স্টেশনে কুলির কাজ শুরু করে। পরে রুটির দোকানে কাজ করে বড় হতে থাকে। স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায় মাতৃভূমি ও পরিবার স্বজনদের কথা। পথের মানুষ হিসেবেই সেখানে সে বড় হতে থাকে। এক সময় ভারতের নদীয়ায় এক লোকের কাছে আশ্রয় মেলে তার। সেখানে সে বিয়ে করে সংসারীও হয়। তার দুই মেয়ে এখন স্কুলে লেখাপড়া করছে।
তিনি আরো জানান, আমি ভীষণ খুশি। ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে মাকে দেখায় আর তর সইছে না। বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে আমার। দীর্ঘ ৩০ বছর পর আমার মা ও মাতৃভূমির সন্ধান পেয়েছি। সন্তান হিসেবে মায়ের প্রতি যে দায়িত্ববোধ থাকা উচিত আমি তা পালন করতে চাই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হারিয়ে যাওয়া এই আমি পথে পথে ঘুরেছি। আজ আমার মাকে পাওয়ার অপেক্ষাটাই ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। মাকে পাওয়ার আনন্দটা শেয়ার করার জন্য শিগগিরই আমার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে মঠবাড়িয়ার নিজের ভিটে মাটিতে ফিরে আসবো। আমি এখন এই অপেক্ষার প্রহর গুনছি।
অমলের মেজ ভাই বিমল গোলদার জানান, আমার ছোট ভাই হারিয়ে যাওয়ার পর আমরা তার আর খোঁজ পাইনি। বহু চেষ্টার পর পরিবারের সবাই ধরে নেই অমল হয়তো আর বেঁচে নেই। কিন্তু ঈশ্বর তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। হারানো রক্তের ভাইকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ বলে বোঝানোর মতো নয়। আমরা সবাই এখন অমলের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি।
M | T | W | T | F | S | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | ||||||
2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 |
9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 |
16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 |
23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 |
30 | 31 |