নির্বাচন কমিশন (ইসি) জেলা পরিষদ নির্বাচন স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করতে বর্তমান প্রশাসকদের প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতার বিষয়ে নতুন বিধি করেছে। জেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাইলে একজন প্রশাসককে আগে পদত্যাগ করতে হবে। এই বিধি যোগ করে সংশোধনী আনা হয়েছে স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইনে।
সংশোধনীটি সোমবার মন্ত্রিসভায় তোলা হবে। সেটি অনুমোদন পেলে জেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা হারাবেন প্রশাসকরা।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জেলা পরিষদ নির্বাচন করতে চাইছে সরকার। তাই আইনি বিষয়গুলোর প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার চেষ্টা চলছে।
জেলা পরিষদ আইনে সংশোধনীর বিষয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে জানান, জেলা পরিষদ আইনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা সম্পর্কে বলা থাকলেও প্রশাসকের বিষয়টি সেখানে উল্লেখ নেই। তাই তাতে সংশোধনীর প্রয়োজন হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা চায় না বর্তমান প্রশাসকরা পদে থেকে জেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হোন। মন্ত্রণালয়ও তাদের সঙ্গে একমত। এ ব্যাপারে আইনে সংশোধনী আনা হচ্ছে। কাল সোমবার মন্ত্রিসভায় সংশোধনীটি তোলার কথা রয়েছে।
নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য জেলা পরিষদের প্রশাসক পদত্যাগ করলে নির্বাচনকালে পরিষদের দায়িত্ব কে পালন করবেন। এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র ঢাকাটাইমসকে বলেন, কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পদ ছেড়ে দিলে নির্বাচনকালীন জেলা পরিষদের দায়িত্বে থাকবেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
স্বপদে থেকে জেলা প্রশাসকরা নির্বাচন করলে তা নিরপেক্ষ নির্বাচনে বাধার কারণ হবে বলে মনে করেন নির্বাচন কমিশনার মোহম্মদ আবদুল মোবারক। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘প্রশাসক পদে থাকা অবস্থায় কাউকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হতে দেয়া ঠিক হবে না। এটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে অন্তরায়। অন্য প্রার্থীদের মধ্যে আস্থার সংকটও সৃষ্টি হতে পারে তাতে।’
জেলা পরিষদ আইন সংশোধন ও তার প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে নির্বাচন কমিশনের সচিব সিরাজুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আইনে চেয়ারম্যানের যোগ্যতা-অযোগ্যতায় প্রশাসকদের বিষয়টি ছিল না। আমরা মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে চিঠি দিয়েছি। বলেছি প্রশাসক থাকা অবস্থায় তারা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হতে পারবেন না।’
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরাও ইসির এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করেন, পদে থাকা অবস্থায় প্রশাসকদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার অনুমতি দিলে নির্বাচনে অযাচিত হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকবে। প্রশ্ন উঠতে পারে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়েও। তাই প্রভাবমুক্ত একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রশাসকদের ক্ষমতায় রেখে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া ঠিক হবে না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জেলা পরিষদ প্রশাসক নির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। প্রশাসক পদে থেকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া মোটেই ঠিক হবে না। এতে ওই প্রার্থী অনাকাঙ্ক্ষিত সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করবেন।’
জেলা পরিষদের প্রশাসকদের প্রার্থিতা নিয়ে আইনের এই সংশোধনীটির প্রক্রিয়া দ্রুতই শেষ করতে চায় ইসি। কেননা আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিভাগ সচিব আবদুল মালেক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জেলা পরিষদ নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি। যত দ্রুত সম্ভব প্রক্রিয়াটি (সংশোধন) শেষ করার চেষ্টা চলছে।’
২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ ২০১২ সালের ১৫ অক্টোবর দেশের (তিন পার্বত্য জেলা বাদে) ৬১ জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। এসব প্রশাসকের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা। ইতোমধ্যে কিছু জায়গায় মৃত্যুজনিত কারণে প্রশাসকের পদ শূন্য হওয়ার পর সেখানে একই ধারায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অন্যদের।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে অনুমোদন ও কার্যকর হওয়া বাংলাদেশ সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে। ইতিমধ্যে আইনের দ্বারা ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পরিষদকে প্রশাসনিক ইউনিট ঘোষণা করা হয়েছে। পৌরসভা/ সিটি করপোরেশনও এর অন্তর্ভুক্ত।
পরে নির্বাচনের বিধান রেখে প্রতিটি ইউনিটের জন্য আলাদা আলাদা আইন করা হয়। এই আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচনও হয়েছে। কিন্তু জেলা পরিষদ নিয়ে টালবাহানা চলে আসছে।
স্বাধীনতার পর প্রথম ১৯৮৮ সালে জেলা পরিষদগুলোতে চেয়ারম্যান হিসেবে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয় সংসদ সদস্যদের। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের নিয়োগ বাতিল করা হয়। তখন থেকে একজন সরকারি কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণে চলছিল জেলা পরিষদ। দীর্ঘ ১৮ বছর পর ২০০৯ সালে জেলা পরিষদে প্রশাসক হিসেবে স্থানীয় নেতাদের নিয়োগ দেয় আওয়ামী লীগের সরকার। এবার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচনের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।