এবারের ঈদের ছুটিতে সড়ক ও মহাসড়কে দুই শতাধিকের উপরে মানুষের প্রাণহানীর ঘটনায় সকল মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর আয়োজনে আজ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। মানববন্ধন কর্মসূচির শুরুতে নিসচা চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সকলের কাছে প্রশ্ন করে বলেন, সড়কে এই অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর দায়দায়িত্ব কে বা কারা বহন করবেন। কারণ আগের তুলনায় আমাদের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনার হার কমে আসলেও এই ঈদের ছুটিতে দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার এই হার বৃদ্ধিতে আমাদের আবার শঙ্কার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এর সূত্র ধরে মানববন্ধন কর্মসূচিতে নিসচা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন নিরাপদ সড়কের দাবিতে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরেন। সড়ক ব্যবহারিক সকল মহলের দায়িত্ব কি তারও গুরুত্ব তুলে ধরে সচেতনতা বৃদ্ধির আহবান জানান।
বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দৃষ্টিআকর্ষণ করে তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য। আসুন সকলে মিলে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা করে সড়ক দুর্ঘটনা মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে আসি। উল্লেখ্য আজকের মানববন্ধন কর্মসূচিতে ঈদের ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২০৫ জনের লাশের প্রতিকী অবস্থান শো-ডাউন করে ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়। এতে করে দুই শতাধিক লাশের মিছিলে এবারের ঈদে সড়কের মর্মান্তিক ঘটনার চিত্র ফুটে উঠে।
মানববন্ধন শেষে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে নিসচা কেন্দ্রীয় কার্যালয় কাকরাইল পর্যন্ত র্যালী অনুষ্ঠিত হয়। র্যালী নিসচা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চনসহ নিসচা নেতৃবৃন্দ ও সর্বস্তরের জনতা অংশগ্রহণ করেন।
মানববন্ধনে নিরাপদ সড়ক আন্দো্লনের পথিকৃৎ ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়কে দুই ধরণের চালক রয়েছে। এক দক্ষ চালক, দুই অদক্ষ চালক, ধৈর্য্যশীল চালক, অধৈর্য্যশীল চালক, মানবিক চালক, অমানবিক চালক, ভালো ব্যবহারের চালক, মন্দ ব্যবহারের চালক- অথচ যারা দক্ষ, ধৈর্য্যশীল, মানবিক ও ভালো ব্যবহারের চালক তারা অদক্ষ, অধৈর্য্যশীল, অমানবিক ও মন্দ ব্যবহারের চালকদের জন্য সমাজে হেয় হচ্ছেন, ঢালাওভাবে দোষী হচ্ছেন, অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছেন। অদক্ষ, অধৈর্য্যশীল, অমানবিক ও মন্দ ব্যবহারের চালকদের জন্য সড়ক অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে, সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। ফলে দক্ষ, ধৈর্য্যশীল, মানবিক ও ভালো ব্যবহারের চালকেরাও এর দায় বহন করছেন। আজ সময় এসেছে এদের চিহ্নিত করে আপনাদেরই নিবৃত্ত করতে হবে। অদক্ষ, অধৈর্য্যশীল, অমানবিক ও মন্দ ব্যবহারের চালকেরা যেন সড়কে গাড়ি না চালাতে পারে, কাউকে যেন গাড়ির চাকায় পিষ্ট করে না মারতে পারে সে দিকে কঠোর নজরদারী করতে হবে। এই ধরনের চালকদের ‘কাউকে মারবো না, ঠিকমত গাড়ি চালাবো’ এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
চালকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনাদের আরেকটা কথা জানতে হবে- গতির একটা ক্ষতি আছে। অর্থাৎ যত গতি তত ক্ষতি। অতি গতি নিয়ন্ত্রণহীন। দ্রুত গতিতে গাড়ি যখন সড়কে চলাচল করে তখন গাড়ি হালকা হয়ে যায়, তখন রাস্তা এবং গাড়ির চাকার মাঝে একটা গ্যাপ তৈরী হয়। যেমন জাপানে একটি ট্রেন যখন ৩০০ কিঃ মিঃ বেগে চলে তখন রেল লাইনের সাথে ঐ ট্রেনের চাকার একটা গ্যাপ তৈরী হয়। কিন্তু ট্রেনটি নিয়ন্ত্রণ করে চুম্বক যে কারণে গতি কমে এলে লাইনের উপরেই ট্রেনটি থামে। কিন্তু সড়কেতো এই ব্যবস্থা নেই। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট গতি বেগের বাহিরে গাড়ি চালালে তখনই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। আরেকটি কথা মনে রাথতে হবে। ওভার স্পীডে গাড়ি চলার সময় গাড়ি হালকা হয়ে যায়। তখন সামান্য একটু টোকা লাগলে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। অতএব গতির যে ক্ষতি আছে তা আজ থেকে মাথায় নিয়ে আগামীতে গাড়ি চালাবেন। আরেকটি কথা এই গতি কতটা শক্তিশালী তা বিমান আকাশে উড়ার দিকে তাকালে বোঝা যায়। যেমন বিমান যখন আকাশে উঠে তখন অতিরিক্ত গতি দিয়ে উঠাতে হয়। আবার যখন নামে তখন গতি কমিয়ে আনতে হয়।গতিই একটি বিমানকে যেখানে আকাশে উঠতে সাহায্য করে সড়কে ঐ গতি একটি গাড়িকে অনিরাপদ করে তোলে। এই বিষয়টি আপনদের মনে রাখতে হবে।
তিনি বলেন, ওভারটেকিং এর ব্যাপারে প্রতিটি সড়কে একটি নির্দেশিকা আছে কোথায় ওভারটেক করতে হবে কোথায় করা যাবে না। অতিরিক্ত গতিতে ওভারটেকিং করবেন না। নিয়ম মেনে গতি কমিয়ে গাড়ির ব্যাস দেখে সামনের গড়ির দুরত্ব অনুধাবন করে সঠিক মাপে ওভারটেকিং করবেন। তেমনি আপনি যেমন ওভারটেক করবেন অন্যকেও ওভারটেক করতে দিবেন। নিজে করবেন অন্যকে করতে দিবেন না- এই মানসিকতা থেকে আপনাদের বের হয়ে আসতে হবে। সবশেষে বলবো নিয়ম মেনে গাড়ি চালাবেন, নিরাপদে বাড়ি ফিরবেন, এই প্রতিজ্ঞা করে প্রতিদিন সড়কে নামবেন।
তিনি আরও বলেন, নিরাপদ সড়ক চাই’র মনিটরিং টিমের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে ঈদের ছুটিতে শুধুমাত্র ১৪০টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে অন্তত ২০৫ জনের। আহতের সংখ্যা ৬৩৮ জন। যাদের অনেককে হয়তো চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হবে। এই পরিসংখ্যানে সড়ক দুর্ঘটনার পাশাপাশি নৌ, রেলপথ ও আকাশপথে সংগঠিত দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানও দেয়া হয়েছে। সড়ক-মহাসড়কে সংগঠিত দুর্ঘটনার চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- চলতি মাসের ৮ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর ঈদ মৌসুমে বাস দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর কারণে শুধু বাস উল্টে ও বাসের ধাক্কায় পথচারীসহ ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাসের সঙ্গে ট্রাক, মাইক্রোবাস, কাভার্ডভ্যান, সিএনজি অটোরিক্সা ও মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত হয় ৮৬ জন। এছাড়া ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ডভ্যান, ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা, ভটভটি, লেগুনা, নসিমন করিমন ও মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে ২৯ জন নিহত হয়েছে। শুধুমাত্র ট্রাক চাপায় নিহত হয়েছেন ৮ জন। এছাড়া প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩১ জনের প্রাণহানি ঘটে। এদিকে ট্রেন দুর্ঘটনায় তথা রেলপথে ট্রেনে কাটা পড়ে ৬ জন নিহত এবং চলন্ত ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ৫০ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া নৌপথে ঈদযাত্রায় ৮টি দুর্ঘটনায় ১০ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়েছে। এবার আকাশ পথেও একটি দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে কক্সবাজারে নামিয়ে দিয়ে ঢাকায় ফেরার পথে স্থানীয় রিজুখাল এলাকায় হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে ১ জন নিহত ও ২ জন আহত হয়। অতএব এই ঈদে সংগঠিত দুর্ঘটনায় এই লাশের মিছিলে আমরা স্তম্ভিত। প্রশ্ন রেখে ইলয়াস কাঞ্চন বলেন, যেখানে সড়ক দুর্ঘটনার হার কমে আসছে সেখানে কেন এবং কি কারণে এই ঈদে দুর্ঘটনার হার বেড়ে গেল। কেন এমন হচ্ছে? সড়ক মহাসড়কে এই লাশের মিছিল, স্বজনদের কান্না থামাবে কে? সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়াবে কে? নিরাপদ সড়ক চাই’র পর্যবেক্ষণে আমরা এই সড়ক দুর্ঘটনার কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করতে পেরেছি। কারণগুলো হলো অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রোড ডিভাইডার না থাকা, ট্রাফিক আইন না মানা, চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানো (বিশেষ করে গাড়ি চালকরা ঈদের ছুটির আগে এবং পরে বেশি ট্রিপের আশায় পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিয়ে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়েছে)। তাই মহাসড়কগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়ম ভেঙে গাড়ি চালানোর জন্য দুর্ঘটনা ঘটছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গতিশীল অবস্থায় গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ছে। এ জন্য চালকদের দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো বন্ধে কঠোর নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া মানুষের জীবন এখন এতই মূল্যহীন হয়ে গিয়েছে যে, পেছন থেকে আসা যানবাহনগুলোর অনেক চালকেরা এখন মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত সরকারের নীতিনির্ধারণী সভায় পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জোরগলায় প্রতিশ্রুতি দিলেও দেখা যায় তাদের অনেকেরই যান মহাসড়কে বেপরোয়া গতিতে ছুটছে। ঈদ মৌসুমে বেশি ট্রিপ মেরে বাড়তি লাভের আশায় চালককে তাঁরা বাধ্য করছেন জোরে চালাতে। আর ঐসব মালিকদের বাসের বেপরোয়া গতি, গাড়ির ফিটনেসহীনতা নিয়ে মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়ানোয় দুর্ঘটনা বাড়ছে, প্রাণ যাচ্ছে সাধারণের। এবারের সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম আরেকটি কারণ হচ্ছে ট্রাক। সাধারণত আমরা দেখে থাকি ঈদের তিন দিন আগে ও তিন দিন পরে মহাসড়কে ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকে। কিন্তু এবার এই সময়ে ট্রাকের সঙ্গে অন্য বাহনের সংঘর্ষে দুর্ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ এই বিষয়টির নজরদারি হয়নি বলেই ট্রাকের মাধ্যমে দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এবার ঈদের ছুটিতে যে সড়ক দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে আমি নিয়মিত তা পর্যবেক্ষণ করেছি। লক্ষ্য করেছি এবার মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার বিষয়টি। যাতে ঘাটতি ছিল। তথ্যমতে দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেকেই নিজ দায়িত্ব পালন না করে ঈদ উৎসব পালনে ব্যস্ত ছিলেন। সে কারণে যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবে এবারও ঈদে সড়ক দুর্ঘটনায় বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আরেকটি কথা না বললেই নয়, সাধারণত প্রতিবছর ঈদে সুষ্ঠুভাবে সড়ক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করা হয়। সেই সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতুবিভাগ, রেলপথ এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীবর্গ ও সচিবগণসহ সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তা, বিআরটিএ প্রতিনিধি, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, নৌ, রেলপথ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, সকল শ্রেনীর যানবাহন মালিক সমিতি, সকল শ্রেনীর শ্রমিকদের প্রতিনিধি, সকল স্টেক হোল্ডার প্রতিনিধিসহ সড়ক নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে থাকেন। সভায় ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের নির্বিঘ্নে যাতায়াতের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এবার এই সভা অনুষ্ঠিত হয় নি। ফলশ্রুতিতে আমরা বলতেই পারি যদি এ সভা অনুষ্ঠিত হতো তাহলে এবারের ঈদে সড়ক ব্যবস্থাপনায় ঐ সভার সিদ্ধান্ত অনেকটা কার্যকর হতে পারতো। ফলে এতগুলো সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটতো না এবং মূল্যবান প্রাণহানীও হতো না।
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, গত ২৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে ঈদের পর এ পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানীর দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে মাননীয় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় যেভাবে পাখির মতো মানুষ মারা গেছে তার দায় আমি এড়াতে পারি না। সরকারের পক্ষ থেকে আমি সে দায় স্বীকার করে নিয়েছি। যদিও আমি চালকও নই, মালিকও নই। তারপরও দায় নিচ্ছি। এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারি সড়ক দুর্ঘটনারোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিয়েছি। মাননীয় মন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর আর কীইবা বলার থাকে। বক্তব্যে তিনি গাড়ির চালক এবং মালিকের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। আমরা বলতে চাই সড়ক দুর্ঘটনার দায় কোন একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না। আমরা মনে করি সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে চালক, মালিক, যাত্রী, পথচারী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সকলেরই দায় দায়িত্ব রয়েছে। সকলের দায়-দায়িত্বেও পাশাপাশি এক্ষেত্রে যাত্রীদের করণীয়টাকে আমরা প্রাধান্য দিতে চাই। সাধারণত ঈদের ছুটিতে ঢাকা ছেড়ে বিপুল পরিমাণ মানুষ তাদের পরিবারের কাছে গ্রামের বাড়িতে যান। আর অতিরিক্ত মানুষের চাপে মহাসড়কগুলোতে যান চলাচলও বেশি হয়। যা মহাসড়কে দুর্ঘটনার বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ। এক্ষেত্রে রেলপথকে আরো সম্প্রসারিত করে, ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে এবং আধুনিকিকরণ করে বিশেষ বিশেষ সময়গুলোতে সড়ক-মহাসড়ক থেকে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ কমানোর জোর সুপারিশ করছি।
বিশেষ করে যানবাহনের মালিক ও সংশ্লিষ্টরা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় নিয়ম ভঙ্গ করে ঈদের সময় মহাসড়কগুলোতে ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে চালান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেও চোখকে ফাঁকি দিয়ে। অতএব সবার উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই ঈদে বাড়ি ফিরতেই হবে এমন মানসিকতা পরিহার, অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে ভ্রমণ না করা, গাড়িতে ঘুমিয়ে না যাওয়া, চালককে জোরে গাড়ি চালাতে না বলা, ধৈর্য্য সহকারে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা, যদি বাড়ি ফিরতেই হয় তাহলে পরিবারের সদস্যদের ছুটির আগেই বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া-এক্ষেত্রে যদি দায়িত্বশীলতার পরিচয় এবং সচেতন থাকেন তাহলে সড়কে যাত্রীদের চাপ কমে আসবে। সেক্ষেত্রে মালিকরাও তখন অতি লাভের আশায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামাবেন না, চালকেরাও অতিরিক্ত ট্রিপের আশা করবেন না, গাড়ি চালনায় পর্যাপ্ত বিশ্রাম পাবেন। যার ফলে আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি সড়কে দুর্ঘটনার ভয়াবহতা অনেকাংশে কমে আসবে।
তিনি বলেন, আসল কথা হলো সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারিভাবে কোনো ব্যবস্থাপনা আমাদের নেই। আমরা মনে করি এ জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বিশেষকরে ঈদে চাপ সামলাতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। সড়ক দুর্ঘটনার এই ব্যাপকতায় আমি একটি পত্রিকায় বলেছি বাংলাদেশে ঈদের ছুটিতে মানুষ যেমন তার শেকড়ের টানে গ্রামের বাড়িতে যান সেভাবেই মানুষ সৌদি আরবে হজ পালন করার উদ্দেশে যান। কিন্তু সৌদিতে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের চাপ সামলানোর জন্য আলাদা ব্যবস্থাপনা থাকে, যা বাংলাদেশে নেই। সৌদিতে রাস্তার পাশে কোনো অবকাঠামো নেই। অথচ আমাদের মহাসড়কগুলোর দুই পাশেই মানুষের ঘর-বাড়ি, দোকানপাটসহ অর্থনৈতিক নানারকম স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নসিমন, করিমন ও ইজিবাইকের মতো যানবাহন। যা মহাসড়কে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের মাধ্যমে এই বিষয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি। ২০৫০ সালে দেশের জনসংখ্যা ৩০ কোটিতে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দুশ্চিন্তা হচ্ছে এখনই মানুষের চাপ সামলাতে সবাইকে হিমসিম খেতে হচ্ছে সেখানে সংশ্লিষ্টরা ঐ বিপুল পরিমাণ মানুষের চাপ কীভাবে সামলাবেন। তাই আমি জোরকণ্ঠে বলতে চাই এ জন্য অন্তত ১০ বছর আগ থেকেই পরিকল্পনা নিতে হবে।
‘আসলে সমস্যা হয়ে গেছে কার ঘাড়ে দোষ চাপাবো’- জাতীয় সংসদে মাননীয় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে কতটুকু অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে সচেতনমাত্র যে কেউ অনুধাবণ করতে পারেন। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে তিনি দায় স্বীকার করে নিলেও বলেছেন, আমি চালকও নই মালিকও নই। কথা হচ্ছে এই চালক, মালিক কিংবা যান এবং সড়ক সংশ্লিষ্ট যারা তাদের দায়িত্ব কারা নেবেন বা তাদের দায়িত্ব কি- মন্ত্রী তো বললেন আমরা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। মন্ত্রী আরও বলেন, ঈদের সময় ওভার টেকিং, ওভার স্পিড, এমনকি থাকে ওভার লোডিংও। সড়ক দুর্ঘটনায় এই কারণগুলো নিরাময়ের দায়িত্ব কার?
তিনি আরও বলেন, জাতীয় সংসদের একজন সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ বলেছেন, বাসের কোনো লাইসেন্স নেই, ফিটনেসও নেই, অনেক চালকেরও কোনো লাইসেন্স নেই- একজন সংসদ সদস্যের মুখ থেকে যদি এ কথা জাতীয় সংসদে আসতে পারে তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে সড়কে যে সব যান চলছে তা কী করে চলছে। এবারের সংগঠিত সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতায় গণমাধ্যমের কাছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক বলেছেন, চালকরা বেশি ট্রিপের চাপে ছিল। যেখানে চারটি ট্রিপ দেওয়া উচিত ছিল সেখানে ট্রিপ হয়েছিল পাঁচটা বা ছয়টা। কিন্তু সেই চাহিদার তুলনায় দক্ষ চালক নেই, এমনকি তৈরিও হয়নি। ফলে অতি লাভের আশায় অদক্ষ চালকদের হাতে মালিকরাই চাবি তুলে দিয়েছিল। যার কারণে এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনার এই ভয়াবহতা আমাদের লক্ষ্য করতে হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে একজন সংসদ সদস্য এবং একজন সচিব যদি এই কথা বলে থাকে তাহলে সড়কে নিয়ম-শৃঙ্খলার কতটুকু ব্যত্যয় হয়েছে।
তিনি বলেন, গত বছর সড়ক নিরাপত্তা পরিষদের সভায় চালকদের প্রতি পাঁচ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৩০ মিনিট বিশ্রাম দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে এবারের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে বাস ও বিভিন্ন পরিবহনের মালিক ও চালকেরা অতিরিক্ত লাভের তা মানেন নি। বরং ট্রিপ বেশি দিয়ে বেশি লাভের জন্য ঈদ মৌসুমে চালকদের দ্রুত বাস চালাতে তারা বাধ্য করেছেন। এই প্রসঙ্গে পত্রিকান্তরে একজন চালক বলেছেন, ‘ঈদের সময় ঢাকা থেকে যাওয়ার পথে যানজটের জন্য ট্রিপ অর্ধেকে কমে যায়। প্রায় সড়ক-মহাসড়কে দীর্ঘ ১০ থেকে ২০ কিলোমিটারব্যাপী যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। তা পোষাতে হয়েছিল বেশি ট্রিপ দিয়ে। তাই আমাদের ঘুমের কোনো নিয়ম বালাই ছিল না। বিশ্রাম নেয়ার সুযোগই পাই নি। যানজট না থাকলে হয়তো এমনটি হতো না।’
হ্যাঁ আমি বলবো সড়কের অপ্রতুলতা এবং ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত চাপে যানজটের সৃষ্টি হয়। সেইসাথে এই যানজটে পড়ে চালকরা যে সময় পার করেন তা খালি রাস্তা পেলে ওভারস্পীডে গাড়ি চালিয়ে পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে থাকেন। ফলে ওভারস্পীডের কারণে সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আমাদের নজরে এসেছে। অতএব জোর দাবি জানিয়ে বলছি- সড়কের এসব বিদ্যমান কারণ প্রশমন করা না গেলে মৃত্যুর মিছিল বাড়বে বৈ কমবে না।
আরেকটি কথা না বললেই নয়, সড়ক দুর্ঘটনার মত দেশের একটি দুর্যোগসম এই সমস্যা নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনীহা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। আমরা প্রায়শই দেখে থাকি দেশের কোন সমস্যায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জাতীয় ঐক্যের কথা বেশ জোর দিয়ে বলে থাকেন। উদাহরণ হিসেবে গুলশানে জঙ্গি হামলার ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। তখন আমরা দেখেছি সরকারী, বিরোধীদল- দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যের কথা বলে সরব হয়ে উঠেছিলেন। সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি নিয়ে যদি তারা আন্তরিক হন তাহলে সড়কের অপঘাতে মৃত্যুর হার কমে আসতে বাধ্য। তাই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে অনুরোধ করবো সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টিকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে এই সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হয়ে উঠবেন।
নিরাপদ সড়ক চাই আয়োজিত আজকের মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নেন নিসচা কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসান- উল হক কামাল, মহাসচিব শামীম আলম দীপেন, যুগ্ম মহাসচিব সাদেক হোসেন বাবুল, লিটন এরশাদ ও লায়ন গনি মিয়া বাবুল, অর্থ সম্পাদক নাসিম রুমি, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম আজাদ হোসেন, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে আজাদ ও শেখ আবদুর রহমান, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মিরাজুল মইন জয়, প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক ফারিহা ফাতেহ, মোঃ আলাল উদ্দিন (দুর্ঘটনা অনুসন্ধান ও গবেষণা বিষয়ক সহ সম্পাদক, নিসচা), সাবিনা ইয়াছমিন (সহ দপ্তর সম্পাদক, নিসচা), প্রকাশনা সম্পাদক এরফানুল হক নাহিদ, আবদুল গফুর সাগর (সহ প্রচার সম্পাদক), আবু সাইদ খান (কার্যকরী সদস্য) মোঃ কামাল হোসেন খান (কার্যনির্বাহী সদস্য, নিসচা), কানিজ ফাতেমা মঞ্জুলি হাজী (কার্যনির্বাহী সদস্য), সুরাইয়া রহমান মনি (কার্যনির্বাহী সদস্য, নিসচা), মোঃ সেকান্দর আলম রিন্টু (কার্যনির্বাহী সদস্য, নিসচা), এডভোকেট দিদারুল আলম দিদার (কার্যনির্বাহী সদস্য, নিসচা), আলহাজ্ব সৈয়দ খায়রুল আলম (কার্যনির্বাহী সদস্য, নিসচা), এম জামাল হোসেন মন্ডল (কার্যনির্বাহী সদস্য, নিসচা), জহিরুল ইসলাম মিশু (উপদেষ্টা- নিসচা, সান্ডারল্যান্ড শাখা, যুক্তরাজ্য), সাধারণ সদস্য ফিরোজ আলম মিলন, ইউসুফ আলী খান, শাহজাহান সাজু, মোঃ মফিজুর রহমান খান বাবু এবং পার্বতীপুর উপজেলা কমিটির আহবায়ক আবু বকর সিদ্দিক রাব্বী প্রমুখ।
এছাড়া নিরাপদ সড়ক চাই’র কেন্দ্রীয় এই কর্মসূচিতে অংশ নেয় শাখা সংগঠন কুমিল্লা জেলা কমিটি, নড়াইল জেলা কমিটি, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলা কমিটি, টঙ্গীবাড়ী উপজেলা কমিটি, রামপুরা থানা কমিটি, ঢাকাস্থ খুলনা কমিটি, পার্বতীপুর উপজেলা কমিটি, বদরুন্নেসা কলেজ কমিটি, যাত্রাবাড়ী থানা কমিটি, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলা কমিটি (প্রস্তাবিত), সাভার উপজেলা কমিটি (প্রস্তাবিত)-এর নেতৃবৃন্দসহ নিসচা সদস্য, স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রীবৃন্দ।
উল্লেখ্য আগামী ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) প্রতিবছর দিনটিকে ঘিরে ব্যাপক কর্মসূচি পালন করে থাকে। প্রতিটি কর্মসূচি পালিত হয় বিষয়ভিত্তিক। দিবসটি ঘিরে এবার ১ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত নানা কর্মসূচি পালিত হবে। এরমধ্যে আজকের মানববন্ধন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের কর্মসূচির সূচনা করা হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রণিক মিডিয়ার আয়োজনে গোলটেবিল বৈঠক, টক-শো, তথ্যচিত্র প্রদর্শণ, সংবাদ সম্মেলন, পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ, সারাদেশে সচেতনতামূলক নাটক ও গান পরিবেশন এবং ২২ অক্টোবর র্যালী, সমাবেশ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল। আমাদের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘দোষারোপ নয়, দুর্ঘটনার কারণ জানতে হবে, সবাইকে নিয়ম মানতে হবে’। আমরা দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার আহবান জানিয়ে জোর দিয়ে বলতে চাই বিদ্যমান সড়ক দুর্ঘটনার কারণ দৃশ্যমান। তা নিরাময়যোগ্য করে গড়ে তুলতে প্রয়োজন নিয়ম মানার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত করা।