বাংলাদেশে এখন ঘরে ঘরে চলছে ইলিশ উৎসব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রায় প্রতিদিনই দেখতে পাচ্ছি সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়রা মন ভরে ইলিশ মাছ কিনছে। খেতে পারছি না, তবুও তাজা রুপালি ইলিশ অথবা রান্না করা ইলিশের ছবি দেখে প্রবাসে বসেও তৃপ্তি অনুভব করছি।

কারণ, এই আমিই তো এক বৈশাখের আগে ইলিশের বাজার নিয়ে প্রতিবেদন করতে গিয়ে দেখেছিলাম, এক হালি ইলিশের দাম ৩২ হাজার টাকা।  সেই ইলিশ নাকি এখন দেশের বিভিন্ন বাজারে দুইশ থেকে বারোশ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে! খুব সহজেই বোঝা যায়, ইলিশ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে কেন এতো উচ্ছ্বাস!

এই উচ্ছ্বাসকে যদি একটি উৎসবে পরিণত করা যায়, তবে ভবিষ্যতে ইলিশ আরও বেশি সহজলভ্য হয়ে যাবে। কেননা বাংলাদেশের মানুষ ভীষণ উৎসবপ্রিয়। উৎসবকে কেন্দ্র করে মাঝে মাঝে অনেক পাগলামীও করে তারা।

পহেলা বৈশাখের কথা্ই যদি বলি, পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার একটা চল আছে। যদিও পহেলা বৈশাখের সাথে ইলিশের কোনো সম্পর্ক আছে কি নেই, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। আমি সেই আলোচনায় যেতে চাই না। আমি শুধু বলতে চাই, পহেলা বৈশাখের সাথে ইলিশকে মিলিয়ে, একটা শ্রেণি বাজারে ইলিশের চাহিদা সৃষ্টি করছে। সেই চাহিদার যোগান দিতে জেলেরাও ধরে আনছে অসময়ের ইলিশ।

কিন্তু যদি পৃথকভাবেই একটা ইলিশ উৎসব করা যায়, তবে পহেলা বৈশাখে মানুষের ইলিশ খাওয়ার প্রবণতা কমে যেতে পারে। তেমনি ইলিশ উৎসবকে কেন্দ্র করে, মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্য জেলেরাও অসময়ে ইলিশ ধরা থেকে সরে আসতে পারে।

ইলিশের প্রজনন মৌসুমে জেলেরা যেন ইলিশ না ধরে সেজন্য তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের কথা বলা হচ্ছে। পাশাপাশি ইলিশের প্রজনন মৌসমে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও সজাগ থাকছে যেন এসময় জেলেরা ইলিশ ধরতে না পারে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও এবার পহেলা বৈশাখে নিজের খাদ্য তালিকায় ইলিশ রাখেননি।

পহেলা বৈশাখে প্রধানমন্ত্রীর ইলিশ না খাওয়া একটি বিশেষ বার্তা বহন করে। বার্তাটি হলো, মানুষ যেন প্রজনন মৌসুমে ইলিশ না খায়, জেলেরা যেন প্রজনন মৌসুমে ইলিশ না ধরে। তারপরও কি মা ইলিশ বা জাটকা ইলিশ নিধন একেবারেই বন্ধ ছিলো? না, বন্ধু ছিল না। অসময়ে ইলিশ ধরা নিয়ে নিয়মিতই প্রতিবেদন করেছে পত্রিকাগুলো। তবে, এই উদ্যোগগুলো প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা কমাতে সাহায্য করেছে অনেকটাই, যার ফলশ্রতিতে দেশের বাজারে এখন অপেক্ষাকৃত কম দামে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।

ইলিশ উৎসব পালন, অসময়ে ইলিশ ধরা ঠেকাতে আরও একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ হয়ে উঠতে পারে। এতো বছর পরে এবার যেভাবে মানুষ দেশের জাতীয় মাছ ইলিশ কিনতে পেরেছে, এমনতেই সেটি একটি উৎসবে পরিণত হয়ে গেছে। কেননা, রুই-কাতলা কিনে তো আর কেউ ফেসবুকে ছবি আপলোড করছে না। সবাই ইলিশের ছবি আপলোড করছে। এটাই একটি উৎসব।

এখন শুধু বাকি একটি আনুষ্ঠানিকতা। সরকার ইচ্ছে করলেই প্রতি বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়কে ইলিশ উৎসব হিসেবে ঘোষণা করতে পারে, ঠিক যে সময়টায় ইলিশ ধরা নিরাপদ হবে। এই উৎসবের মাধ্যমে জেলে থেকে শুরু করে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকেই একটি বার্তা দেয়া যেতে পারে। উৎসব যেমন সবসময় হয় না, তেমনি ইলিশও সবসময় ধরা যাবে না।

দুই একজন মানুষের বিলাসিতা কখনও উৎসব হতে পারে না। একটা ইলিশের পেছনে আট-দশ হাজার টাকা ব্যয় করা এক ধরণের বিলাসিতাই বটে। পহেলা বৈশাখে ধনীরা সেই বিলাসিতাই করে থাকেন। উৎসবের মধ্যে এমন বৈষম্য থাকতে নেই। যার টাকা আছে সে ইলিশ খাবে, আর যার টাকা নেই সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে, সেটি আসলে সমাজে ধনী-গরীবের ভেদাভেদ। সেটি উৎসব নয়।

উৎসব হতে হয় সার্বজনীন। তাই সবাই একসাথে যেন ইলিশ দিয়ে উৎসব পালন করতে পারে, সেজন্য ইলিশের মৌসুমেই একটা ইলিশ উৎসব দরকার। হতে পারে, এই উৎসবটাই জেলে, ক্রেতা-বিক্রেতা, ধনী-গরিব সবাইকে একই সুঁতোয় বেঁধে রাখবে।

লেখক: সাংবাদিক

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031