প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৭১তম অধিবেশনে দেয়া ভাষণে  বলেছেন, ঢাকার গুলশানে জঙ্গি হামলার ঘটনা বাংলাদেশের জনগণের মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে বর্তমানে বাংলাদেশ ‘নতুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে দেশের প্রতিটি স্তর থেকে অভূতপূর্ব সাড়া মিলছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী জনগণের দৃঢ়তা ও সহযোগিতায় বাংলাদেশের মাটি থেকে সন্ত্রাসীদের সমূলে উৎপাটনের দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সরকার প্রধান সন্ত্রাসীদের অর্থ, অস্ত্র ও নৈতিক সমর্থন না দিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। সন্ত্রাসীদের সমূলে উচ্ছেদ করার সংকল্পে বিশ্ববাসী ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসও কামনা করেন তিনি। বুধবার নিউ ইয়র্ক সময় সন্ধ্যায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রায় ১৯ মিনিটের ওই ভাষণের শুরুতে শান্তির পক্ষে ’৭৪ সালে জাতিসংঘে দেয়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অংশ বিশেষও উদ্ধৃত করেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে বাংলাদেশের সরকার প্রধান বলেন, বর্তমান সময়ের দুটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ- জঙ্গিবাদ ও সহিংস চরমপন্থা। এই চ্যালেঞ্জগুলো কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে আবদ্ধ না থেকে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। কোনো দেশই আপাতদৃষ্টিতে নিরাপদ নয়। কোনো ব্যক্তি এদের লক্ষ্যের বাইরে নয়। আমেরিকা থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা  থেকে এশিয়ায় অগণিত মানুষ সন্ত্রাসবাদের শিকার হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, সন্ত্রাসের  কোনো ধর্ম, বর্ণ বা গোত্র নেই। এদের সর্বোতভাবে সমূলে উৎপাটন করার সংকল্পে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সন্ত্রাস ও সহিংস জঙ্গিবাদের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে। একই সঙ্গে এদের পরামর্শদাতা, পরিকল্পনাকারী, মদতদাতা, অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহকারী এবং প্রশিক্ষকদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ভাষণে গত ১লা জুলাইর ঢাকা অ্যাটাকের ঘটনা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে আমরা এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে বাংলাদেশের জনগণকে সচেতন করতে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেশব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এতে সাড়া দিতে পুরো জাতির প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। সমাজের প্রত্যেক স্তর থেকে এ আহ্বানে অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছি। এ সময় প্রধানমন্ত্রী নিজে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হিসেবে সন্ত্রাস ও সহিংস জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তার সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির বিষয়টি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন। বলেন, আমাদের দেশে যেসব সন্ত্রাসী গ্রুপের উদ্ভব হয়েছে, তাদের নিষ্ক্রিয় করা, তাদের নিয়মিত অর্থ সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা এবং বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম নির্মূল করার ক্ষেত্রে আমাদের সরকার সফল হয়েছে। কয়েকটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্রের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় কিছু প্রান্তিক গোষ্ঠী তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পুনঃসংগঠিত হওয়ার মাধ্যমে নতুনরূপে আবির্ভূত হয়ে থাকতে পারে। দীর্ঘ ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ, বিশ্বশান্তির ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান, ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়নে তার সরকারের বাস্তবায়িত চিত্র তুলে ধরেন। বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব পরিস্থিতির ইতিবাচক দিকও তুলে ধরেন। বলেন, আমাদের বিশ্ব বর্তমানে এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যখন এসব অভিশাপ থেকে মুক্তি খুব একটা দূরে নয়। অনেক সৃজনশীল ও প্রায়োগিক সমাধান এখন আমাদের নাগালের মধ্যে। প্রযুক্তি, নব্য চিন্তাধারা ও বৈশ্বিক নাগরিকদের বিস্ময়কর ক্ষমতা আমাদের একটি ‘নতুন সাহসী বিশ্ব’ সম্পর্কে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করছে। তবে এখনো বিশ্ব উত্তেজনা ও ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত নয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বেশকিছু স্থানে সহিংস-সংঘাতের উন্মত্ততা অব্যাহত রয়েছে। অকারণে অগণিত মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। যারা সংঘাত থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন, প্রায়শই বিভিন্ন দেশ তাদের নিরাপত্তা দিতে অস্বীকার করছে। কখনো কখনো অত্যন্ত জরুরি মানবিক চাহিদা অগ্রাহ্য করা হচ্ছে অথবা সেগুলো প্রবেশে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কী অপরাধ ছিল সাগরে ডুবে যাওয়া সিরিয়ার ৩ বছর বয়সী নিষ্পাপ শিশু আইলান কুর্দির? কী দোষ করেছিল ৫ বছরের শিশু ওমরান, যে আলেপ্পো শহরে নিজ বাড়িতে বসে বিমান হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। একজন মা হিসেবে আমার পক্ষে এসব নিষ্ঠুরতা সহ্য করা কঠিন। বিশ্ব বিবেককে কি এসব ঘটনা নাড়া দেবে না?
অন্যান্য প্রসঙ্গে: প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে শরণার্থী সংকটসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের প্রসঙ্গ আসে। জাতিসংঘের অভিবাসী ও শরণার্থীবিষয়ক সম্মেলনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার প্রত্যাশা এই সম্মেলন বর্তমান সময়ে অভিবাসনের ধারণা ও বাস্তবতাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে সাহায্য করবে। অভিবাসী ও শরণার্থীদের স্বদেশ ও গন্তব্য উভয় স্থানের জন্যই সম্ভাবনাময় পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশ নিরাপদ, সুশৃঙ্খল ও নিয়মিত অভিবাসনসংক্রান্ত গ্লোবাল কমপ্যাক্ট রূপরেখা প্রণয়নে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। শেখ হাসিনা বলেন, আগামী ডিসেম্বরে ঢাকায়  গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (জিএফএমডি) আয়োজন করা হচ্ছে। সেখানে অভিবাসনবিষয়ক গঠনমূলক সংলাপের প্রত্যাশা করছি। ভাষণে জাতিসংঘের বিদায়ী মহাসচিব বান কি মুনের ভূমিকার প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি (মুন) সব সময়ই একজন বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়নের অর্জনগুলোকে বিশ্বের অন্য দেশের জন্য ‘রোল মডেল’ হিসেবে তুলে ধরেছেন। বিশ্বায়নের নানা চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সরকার প্রধান বলেন, চ্যালেঞ্জ আছে, তবে যদি সঠিক পন্থা অবলম্বন করা হয়, তাহলে সম্ভাবনা ও সুযোগও রয়েছে অনেক। বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এক মানবতার জন্য কাজ করার উদ্দেশ্যে আমরা সকলে এখানে সমবেত হয়েছি। মতের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও আসুন আমরা মানবতার স্বার্থে অভিন্ন অবস্থানে উপনীত হই। বিশ্ব থেকে সংঘাত দূর করে শান্তির পথে এগিয়ে যাই। এক্ষেত্রে জাতিসংঘই হতে পারে আমাদের জন্য একটি অনন্য প্ল্যাটফরম। আসুন, আমরা এই সংস্থাকে আরো টেকসই ও প্রাসঙ্গিক করে তুলতে নতুন করে শপথ গ্রহণ করি। ভাষণে টেকসই উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। নারী শিক্ষা বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপের ফল  পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নারীরা এখন উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশীদার। সব পেশায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে  শেখ হাসিনা বলেন, সম্ভবত বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ,  যেখানে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, সংসদ উপনেতা সবাই নারী।
এসডিজি ও বাংলাদেশ: প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে জাতিসংঘ গৃহীত উন্নয়ন পরিকল্পনা এসডিজি এবং বাংলাদেশের সামপ্রতিক কিছু উন্নয়ন অগ্রগতির বিষয়ে কথা বলেন। বলেন, গত বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে আমরা একটি উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন এজেন্ডা-টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) গ্রহণ করেছি। এই এজেন্ডার রাজনৈতিক অঙ্গীকারকে পশ্চাদপদ দেশগুলোর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ এবং অর্থবহ অবলম্বনে রূপান্তরিত করা প্রয়োজন। এ জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ‘আন্তর্জাতিকভাবে সম্মত উন্নয়ন প্রতিশ্রুতিসমূহের সঠিক বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষে তাদের বর্তমান অবস্থান থেকে উত্তরণ সম্ভব। উদ্ভাবন এবং সম্ভাব্য সম্পদ সরবরাহ ব্যবস্থা জোরদার করতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য প্রস্তাবিত প্রযুক্তি ব্যাংককে দ্রুত কার্যকর করতে হবে’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ইতিমধ্যেই বেশিরভাগ এসডিজিগুলোকে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন নীতিমালায় সমপৃক্ত করেছি। কাজের সমন্বয় ও যাচাইয়ের জন্য আমার তত্ত্বাবধানে একটি প্ল্যাটফরম তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম এবং শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শ চলমান রয়েছে। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা এবং শোষণমুক্ত স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা যে ‘ভিশন-২০২১’ এবং ‘ভিশন-২০৪১’ বাস্তবায়ন করছি, তার সঙ্গে এগুলোর সমন্বয় করা হয়েছে। শেখ হাসিনা তার সরকারের লক্ষ্য ও কার্যক্রম উল্লেখ করে বলেন, আমাদের লক্ষ্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, শক্তিশালী, ডিজিটাল এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। সেজন্য আমাদের সরকার উদ্ভাবনমূলক সরকারি সেবা বিতরণ, জনসাধারণের তথ্য লাভের অধিকার এবং রাষ্ট্র পরিচালনা ও সেবাখাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
‘শান্তির সংস্কৃতি’ বিস্তারের পক্ষে প্রচারণা চালাবে ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘের অন্যতম প্রধান কর্মসূচি ‘শান্তির সংস্কৃতি’র বিস্তারের পক্ষে প্রচার চালিয়ে যাবে। শান্তি রক্ষা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের অবদান অব্যাহত থাকবে। ঢাকায় ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কেন্দ্র’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত সহিংসতার কবল থেকে বেরিয়ে আসা দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ করে দিবে। তিনি বলেন, একইভাবে, আমরা নির্বিচারে হত্যার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা ও বিচার নিশ্চিত করতে জাতীয় বিচারিক প্রক্রিয়ার ভূমিকাকে গুরুত্ব প্রদানে সোচ্চার থাকবো। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য স্থানীয় অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমরা বিগত কয়েক দশকের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। ‘মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া পুনরায় চালু ও ভ্রাতৃপ্রতিম ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি বৈরিতা নিরসনের জন্য সামপ্রতিক প্রচেষ্টাগুলোকে অবশ্যই সঠিক দিকে পরিচালিত করতে হবে। ভাষণে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশনের সভাপতিকে আন্তরিক ও উষ্ণ অভিনন্দন এবং বিগত এক বছর সাধারণ পরিষদে অসাধারণ নেতৃত্ব প্রদানের জন্য মগেনস লিকেটফ্‌ট-কে ধন্যবাদ জানান।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031