মাদক ব্যবসা মহানগরীর ২৫৮টি স্পটে ২৮৪ ব্যক্তি নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ১৬ থানার তৈরিকৃত তালিকার মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৬০ জনই নারী। এসব স্পটে দৈনিক ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার মাদক বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। নগরীর সবচেয়ে বড় তিনটি স্পটই রেলস্টেশন কেন্দ্রিক। অভিযোগ রয়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায় ঝামেলা থেকে বিরত থাকতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে আসছে। আর এজন্য বহাল রয়েছে এসব মাদক সিন্ডিকেট। তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান চলে মাঝে–মধ্যে। তবে তাতে ব্যবসায়ীদের কোন অসুবিধা হয় না, তাদের ব্যবসা চলতেই থাকে। হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, কোকেন, মদ, গাঁজাসহ হরেক রকম মাদক। সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে আজাদীকে বলেন, প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন অভিযানে মাদকের চালান আটক হচ্ছে। ধরা পড়ছে বিক্রেতা। মাঝে মধ্যে মূল হোতারাও বাদ যাচ্ছে না। স্টেশন কেন্দ্রিক মাদক ব্যবসা বন্ধে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে পুলিশ। অচিরেই এর ফল নগরবাসী দেখতে পাবে।এ প্রসঙ্গে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো উপ অঞ্চলের পরিচালক আলী আসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সমন্বিতভাবে আমরা মাদক ব্যবসার মূল হোতাদের নির্মূলে নামছি। সেখানে রেল স্টেশন কেন্দ্রিক মাদকের হাট অগ্রাধিকার পাবে। জানা গেছে, ভৌগোলিক এবং অবস্থানগত দিক থেকে মাদক পাচারকারীরা চট্টগ্রামকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা সারাদেশে পাচারের একমাত্র রুট চট্টগ্রাম। সড়ক ও নদীপথে কক্সবাজার, টেকনাফ থেকে ইয়াবা চট্টগ্রামে আসছে। পাশাপাশি মিয়ানমার হয়ে নদীপথে আসছে ফেনসিডিল, কোকেন ও বিদেশী মদ। অপরদিকে ভারত থেকে কুমিল্লাসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে আনা ফেনসিডিল ও গাঁজা চট্টগ্রামে আসছে সড়ক ও রেলপথে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ সম্প্রতি ১৬ থানা এলাকায় যারা মাদক ব্যবসা করছে তাদের একটি তালিকা তৈরি করেছে। তাদের মধ্যে ১৬ থানায় ২৫৮টি স্পটে মাদক বিক্রি করছে ২৮৪ ব্যক্তি। এর মধ্যে কোতোয়ালিতে ৫৪ স্পটে ৯৬ জন, সদরঘাটে ৪ স্পটে ৪ জন, চকবাজারে ৩ স্পটে ৩ জন, বাকলিয়ায় ২৪ স্পটে ২৪ জন, খুলশীতে ২৬ স্পটে ২৬ জন, পাঁচলাইশে ২২ স্পটে ৫ জন, চান্দগাঁওতে ১২ স্পটে ১৬ জন, বায়েজিদ বোস্তামীতে ১৩ স্পটে ১৩ জন, পাহাড়তলীতে ২৪ স্পটে ২০ জন, আকবরশাহে ১৯ স্পটে ১৯ জন, হালিশহরে ১৪ স্পটে ৪ জন, ডবলমুরিংয়ে ২০ স্পটে ২০ জন, বন্দরে ৬ স্পটে ৪ জন, ইপিজেডে ৪ স্পটে ১৫ জন, পতেঙ্গায় ৩ স্পটে ৫ জন এবং কর্ণফুলীতে ১০ স্পটে ১০ জন। নগরীর ব্যস্ততম রেলস্টেশন সংলগ্ন বরিশাল কলোনিতে প্রতিদিন বসছে মাদক বেচাকেনার হাট। বরিশাল কলোনি ভেঙে দেয়া হলেও মালিকানা বদলের মাধ্যমে মাদক ব্যবসা চলছে আগের মতোই রমরমা। পুরাতন রেল স্টেশন (গোডাউন গেইট) এলাকায় রাস্তার উপরেই কবিরের গাঁজার স্পট। বছর পাঁচেক আগেও সে ছিল স্টেশনের কুলি। আর বর্তমানে সে কয়েক কোটি টাকার মালিক। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় তার বিরুদ্ধে মামলাও নেই তেমন। তার হয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে তার শ্যালক গুজাইয়া। গাঁজার ব্যবসা ছাড়াও ট্রেনযোগে চোরাই পথে কিসমিস, এলাচ, দারুচিনি, জিরা এনে রেয়াজউদ্দিন বাজারে সাপ্লাই দেয় কবির।
একইভাবে মাদকের আরেকটি বড় স্পট রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন বাস্তুহারা কলোনি। এ কলোনিকে ঘিরে মাদক ব্যবসা এতটাই জমজমাট যে, সম্প্রতি কলোনির দখল পাল্টা দখল নিয়ে শফিক নামে এক যুবক খুনের ঘটনাও ঘটে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেলস্টেশন এলাকায় মাদক বিক্রয় ও বহন কাজে মূলত ভাসমান শিশু ও মহিলাদের ব্যবহার করা হয়। যুবকদের রাখা হয় তথ্য আদান–প্রদানকারী, দাঙ্গা–হাঙ্গামা, টাকা–পয়সা বণ্টন ও হিসাব–নিকাশের কাজে। আর সহায়তা করে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন বিভাগের সোর্সরা। অথচ পাশেই রয়েছে জিআরপি পুলিশ ও রেলের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীর স্থাপনা। কিন্তু তাদেরকে নিয়মিত মাসোহারা দেয়ার কারণে তারা এই অবৈধ কাজগুলো দেখেও না দেখার ভান করে। অভিযোগ রয়েছে রেল স্টেশন ও রেলগাড়ি কেন্দ্রিক মাদক ব্যবসার সাথে রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি), রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি), আনসারও জড়িত। অন্য সময়ের তুলনায় বর্তমানে রেল কেন্দ্রিক মাদক ব্যবসা তাই আশংকাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন জিআরপি থানার ওসি হিমাংশু কুমার দাশ। তিনি বলেন, আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে রেলপথে মাদকসহ যেকোন চোরাই পন্য যাতে আনা নেয়া বন্ধ থাকে। এ এলাকায় মাঝে মাঝে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে থাকে। কিন্তু দেখা গেছে– অভিযান চালানোর সংবাদ অপরাধীরা আগেই পেয়ে যায়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীতে থাকা কতিপয় অসাধু সদস্যরা অভিযানের সংবাদ ফাঁস করে দেয়। এমনকি এই এলাকায় মহানগর পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, র্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লোকজনরা অভিযান চালাতে গিয়ে কয়েকবার হামলারও শিকার হয়েছেন। গোয়েন্দা পুলিশ ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানায়, ঐ এলাকায় বহুবার অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযান চালাতে গেলে সেখানকার অপরাধী চক্র কয়েকবার তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। শুধু বরিশাল কলোনি বা কবিরের গাঁজার মাদক বিক্রি ও সেবনের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে উল্লেখযোগ্য হল– রেলস্টেশন এলাকা, আইসফ্যাক্টরি রোড, রেয়াজউদ্দিন বাজার পোস্ট অফিস গলি, লালদীঘির পাড়, টাইগারপাস, বার্মা কলোনি, হাজারী গলি, পশ্চিম মাদারবাড়ি, সিআরবি বস্তি, গোসাইলডাঙ্গা ডাইল ব্রিজ, হালিশহর বিহারি কলোনি, পশ্চিম রামপুর মিয়ার বাড়ি, মতিঝর্না কলোনি, সেগুন বাগান কলোনি, শেরশাহ কলোনি, চৈতন্য গলি কবরস্থানের পাশে, সিআরবি চৌদ্দ জামতলা বস্তি, বয়লার কলোনি, গোয়াল পাড়া, আসকার দীঘি বালুর মাঠ, বক্সিরহাট, পাথরঘাটা, এয়াকুবনগর, রফিক কলোনি, এনায়েতবাজার, ঝাউতলা, ব্যাটারি গলি, টেরিবাজার, বাকলিয়া তক্তারপুল, নিমতলা বস্তি, বড়পোল খাল পাড়, চন্দ্রনগর ইয়াসিন কলোনি, কদমতলী বাস স্ট্যান্ড, আগ্রাবাদ বাস্তুহারা কলোনি, পাহাড়তলী ডেবা কলোনী, বাকলিয়া বউ বাজার, অলংকার, কমার্স কলেজ এলাকা। জানা গেছে, মাদক ব্যবসায়ীরা সাধারণ চার স্তরে বিভক্ত। ১ম স্তরে থাকে প্রভাবশালী ও মূল হোতারা। এদের চিহ্নিত করা বেশ কঠিন। অনেক সময় এদের সঠিক কোনো পরিচয় নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে সর্বোচ্চ অর্থাৎ প্রথম স্তরে থাকারা অসম্ভব ক্ষমতাশালী এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মহলের রাঘব বোয়াল। দ্বিতীয় স্তরেও রয়েছে প্রভাবশালী চক্র। তৃতীয় ও চতুর্থ স্তরের বিক্রেতা বা বহনকারীরা সাধারণ অভিযানে আটক হন। আর জিজ্ঞাসাবাদ করলেও এরা প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরে থাকা মাদক ব্যবসায়ী মূল হোতাদের নাম বলে না। ফলে আন্তরিকতা ও চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও সবসময় মাদক ব্যবসায়ীদের মূল হোতাদের চিহ্নিত বা আটক করা বেশ কঠিন। তৃতীয় ও চতুর্থ সারির মাদক বিক্রেতারা ধরা পড়লেও আইনের ফাঁকফোঁকর গলিয়ে তারাও বের হয়ে পুনরায় মাদক ব্যবসার কাজে জড়িয়ে পড়ে।
– See more at: http://www.dainikazadi.org/details2.php?news_id=1884&table=september2016&date=2016-09-22&page_id=4&view=0&instant_status=#sthash.7i7YkEgx.dpuf