মিডিয়ার কল্যাণে সারা শহরে রাজকীয় বিয়ের মাতম পড়েছে। সপ্তাহখানেক আগ থেকেই ফেসবুকজুড়ে বিয়ের কার্ড নিয়ে তোলপাড়। অপেক্ষার প্রহর শেষে এলো সেই মাহেদ্রক্ষণ। রং–বেরঙের বেলুন, বর–কনের ছবি সমেত ব্যানার–ফেস্টুনে জমকালো সাজে সেজেছে বিয়েবাড়ি। সানাই বাজছে লীলাবালির সুরে সুরে। গরুর কলিজা, ফুসফুস, হৃদপিণ্ড, মাংস, আস্ত মুরগি ও ডিম মিলিয়ে তৈরি হল ৪৭ কেজি ওজনের অভিনব কেক। বিয়ের বরযাত্রীও (আমন্ত্রিত অতিথি) নেহায়েত কম নয়। শতাধিক শিশুসহ নানা শ্রেণিপেশার অন্তত হাজার দেড়েক দর্শণার্থী। ভিআইপি অতিথিদের ভিড়ে অস্থির চারপাশ। ছিল দুই শতাধিক মানুষের খাবারেরও আয়োজন! চলছে মুহুর্মুহু ক্যামেরার ক্লিক আর সেলফিঝড়। সাথে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় লাইভ সম্প্রচার। তথ্য সংগ্রহ আর ছবি তোলাতে নাভিশ্বাস ব্যস্ততা মিডিয়াকর্মীদের। মোটামুটি একটি রাজকীয় বিয়ের সব আইটেমই ছিল আয়োজনে। ‘বাদশা–নোভা’ বর–কনের এমন নামেও যেন আভিজাত্যের ছোঁয়া। আবার বিয়ে উপলক্ষে বর–কনের নামের মিল রাখতে ‘বাদশা’র নাম বদলে রাখা হয় ‘নভ’। এমন ব্যতিক্রমী বিয়ে কোন মানুষের নয়, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার সিংহ–সিংহীর। গতকাল সকালে নগরীর পাহাড়তলির ফয়েসলেকস্থ চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় বর্ণাঢ্য আয়োজনে মহাসমারোহে হয়ে গেল ব্যতিক্রমী এই বিয়েটা।
‘নভ–নোভা’র ঐতিহাসিক বিয়েতে আসা দর্শণার্থী মীর রাতুল হাসান বলেন, মানুষের বিয়ে তো অনেক খেলাম। জীবনে এই প্রথম পশুর বিয়ে দেখতে এলাম। অনেক মজা লাগছে বিয়ের ব্যতিক্রমী সব আয়োজন দেখে। তবে তিনি একই সাথে মন খারাপের গল্পও শোনান। রাতুল বলেন, আমরা সিরিয়াস ইস্যুতে যতটা না সোচ্চার তার চাইতে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকি অনেক বেশি। এদিকে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, চট্টগ্রামবাসীর জন্যে এ চিড়িয়াখানা বিনোদনের প্রধানতম মাধ্যম। এখানকার দর্শকদের প্রত্যাশাও বেশি। অন্যদিকে বিয়ের এমন ধুমধাম আয়োজন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি হচ্ছে তাদের একসঙ্গে থাকার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। একই সঙ্গে দেশবাসীকে প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসার বার্তা পৌঁছে দেওয়া। অন্যদিকে গতকাল বিয়ে হলেও এখনি সিংহ–সিংহীকে এক খাঁচায় দেওয়া হবে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে। অর্থাৎ ‘নভ–নোভা’র বাসর হবে আজ। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরির জন্যই সিংহ ও সিংহীকে আলাদা খাঁচায় রাখা হয়েছিল। এখন সিংহ আর সিংহী দুটি এক খাঁচায় থাকার উপযোগী হয়েছে। তিনি বলেন, বেশি মানুষের সমাগম হওয়ায় তাদের কাছে পরিবেশটা অপরিচিত লাগছে। তারা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলে আগামিকাল (আজ বৃহস্পতিবার) বিকালের মধ্যেই তাদের এক খাঁচায় রাখা যাবে। মোর্শেদ জানান, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার সিংহ–সিংহীগুলো ‘ইন্ডিয়ান লায়ন’ প্রজাতির। এগুলোর গড় আয়ু ১৫ থেকে ১৬ বছর। কোনো পুরুষ সঙ্গী না থাকায় পূর্ণবয়স্ক সিংহীগুলোর বংশবৃদ্ধির সুযোগ হয়নি। এদের মিলন হলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে ‘নোভা–নভ’ এর সংসারে নতুন অতিথির আগমন ঘটতে পারে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ সালের ১৬ জুন চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় জন্ম নিয়েছিল সিংহ শাবক ‘বর্ষা’ ও ‘নোভা’। দুই বোনের জন্মের কিছুদিন পর তাদের মা ‘লক্ষ্মী’ এবং ২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাবা ‘রাজ’ মারা যায়। এরপর আর কোনো নতুন সিংহ চিড়িয়াখানায় আনা হয়নি। একই সঙ্গে চিড়িয়াখানায় আর কোনো পুরুষ সিংহ না থাকায় ‘বর্ষা’ ও ‘নোভা’ কুমারী থেকে যায়। এতে তাদের ঘর–সংসার করা যেমন হয়ে ওঠেনি অন্যদিকে বংশবিস্তারেও দেখা দেয় সংশয়। আবার মাসখানেক আগে বোন বর্ষাও রংপুরে চলে যাওয়ায় নিঃসঙ্গতায় ভুগছিলো ‘নোভা’। দীর্ঘদিন ধরে অনেক খোঁজখবর নেয়ার পরেও উপযুক্ত পুরুষ সিংহ পাওয়া যায়নি। প্রায় ১১ বছর সঙ্গীহীন জীবন কাটানোর পর সঙ্গী আনার উদ্যোগ নেয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি সংবাদপত্রের মাধ্যমে রংপুর চিড়িয়াখানায় দুটি পুরুষ সিংহ থাকার খবর পায় চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। এরপর ‘বর্ষা ও নোভা’র মধ্য থেকে একটি রংপুর চিড়িয়াখানার সঙ্গে অদল–বদল করে ‘বর্ষা’কে গত ২৮ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে রংপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ‘রাজা’র সঙ্গী হবে ‘বর্ষা’। আর ’নোভা’র জন্যে নিয়ে আসা হয় ‘রাজা’র ভাই ‘বাদশা’কে। গত ৫ সেপ্টেম্বর সকালে রংপুর চিড়িয়াখানা থেকে নোভার সঙ্গী বাদশা এসে পৌঁছায় চট্টগ্রামে। তবে এতোদিন আলাদা খাঁচায় রাখা হয় তাদের। এরপর শুরু হয় ‘বাদশা–নোভা’ যুগল জীবনে পদার্পণ করানোর এলাহি আয়োজন।
এর আগে জিপিএইচ ইস্পাতের সৌজন্যে নির্মিত চিড়িয়াখানার নতুন ফটক উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন। এরপর বিয়ের স্মারক হিসেবে আকাশে বেলুন উড়িয়ে বিয়ের আনুষ্ঠানিক পর্ব শুরু হয়। এ সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ড. অনুপম সাহা, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মমিনুর রশিদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) হাবিবুর রহমান, জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলমাস শিমুল, কবি অভীক ওসমান ও সেলিনা শেলী, চিড়িয়াখানার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শাহজাহান চৌধুরী, পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ রুহুল আমীন, ডেপুটি কিউরেটর চৌধুরী মো. মনজুর মোরশেদ, প্রাণী চিকিৎসক শাহাদাত হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।