প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও যন্ত্রের চাকায় পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনা নয়, এ যেন এক মহামারী।যন্ত্রদানব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। সড়ক হয়ে ওঠেছে অনিরাপদ। নিজ ঘরও এখন যন্ত্রদানবের থাবায় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। গতকাল রাজশাহীতে মহাসড়ক ছেড়ে ঘরে ঢুকে পড়ে একটি বাস। এতে ঘুমন্ত অবস্থায় নিহত হন স্বামী-স্ত্রী। নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি (এনসিপিএসআরআর) সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সাতটি কারণ চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো-বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, নিয়ম ভঙ্গ করে ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং করার প্রবণতা, চালকদের দীর্ঘক্ষণ বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, আনফিট গাড়ি চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ এবং  ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও সড়কের বেহালদশা।
এনসিপিএসআরআর তাদের প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। প্রতিবেদনের তথ্য মতে গত ১০ বছরে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিহত হয়েছে ৫০,৬২৭ জন। দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৪,৭১৬টি। আহত হয়েছেন ৮২,১৫২ জন। এ হিসাব ২০০৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত। আর চলতি বছরের গতকাল পর্যন্ত নিহত হয়েছে আড়াইহাজার জনের উপরে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০টি জাতীয় দৈনিক, আটটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সংবাদ সংস্থা এবং ১০টি আঞ্চলিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনের বছরভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়- গত বছর দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৪৫৯২টি। এতে নিহতের সংখ্যা ৬৮২৩ জন। আর আহতের সংখ্যা ১৪০২৬ জন। ২০১৪ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৫৯৯৭টি। নিহতের সংখ্যা ৮৭৯৮ জন। আর আহতের সংখ্যা ১৮১১৩ জন। ২০১৩ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৪৭৫৬টি। ওই বছর নিহতের সংখ্যা ছিল ৬৮১৩ জন। আহতের সংখ্যা ১১৫২৮ জন। ২০১২ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৪৮১৭টি। নিহতের সংখ্যা ৫৯৫৪ জন। আর আহতের সংখ্যা ছিল ১২৯০৮ জন। ২০১১ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা ৪৯৫৯টি। নিহতের সংখ্যা ৫৯২৮ জন। আহতের সংখ্যা ১১৪৩০ জন। ২০১০ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৩১০৭টি। নিহতের সংখ্যা ছিল ২৬৪৬ জন। আর আহতের সংখ্যা ছিল ১৮০৩ জন। ২০০৯ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৩০৫৬ জন। নিহতের সংখ্যা ছিল ২৯৫৮ জন। আহতের সংখ্যা ৩৪৫৬ জন। ২০০৮ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৪৮৬৯টি। নিহতের সংখ্যা ৩৭৬৫ জন। আর আহতের সংখ্যা ছিল ৩২৩৩ জন। ২০০৭ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৪৭৬৯টি। নিহতের সংখ্যা ৩৭৪৯ জন। আহতের সংখ্যা ছিল ৩২৩৭ জন। ২০০৬ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৩৭৯৪টি। নিহতের সংখ্যা ৩১৯৩ জন। আর আহতের সংখ্যা ছিল ২৪০৯ জন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে সারা দেশে ২০৮২টি দুর্ঘটনায় ৩১১ শিশু ও ৩০১ নারীসহ ২২৪৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৬০৩১ জন। এনসিপিএসআরআর-এর হিসাব অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০১৪ সালে। নিহত এবং আহতের সংখ্যার দিক দিয়েও গত এক দশকে ওই বছর ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
এনসিপিএসআরআর-এর প্রতিবেদনে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে গত ৩১শে জুলাই পর্যন্ত ২১০ দিনে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২২৪৫ জন নিহত হয়েছেন বলে তুলে ধরা হয়েছে। এ সময়ে আহত হয়েছেন ৬০৩১ জন। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ৩১১ জন শিশু, ৩০১ জন নারী। ২০৮২টি দুর্ঘটনায় এ সংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটে।
প্রতিবেদন মতে, জুলাই মাসে ২৫৬টি দুর্ঘটনায় ৩০৪ জন নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে ৪৯ জন শিশু ও ৪০ জন নারী রয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ১২৩৭ জন। জুন মাসে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ২৭৫টি। এতে ৩৩৫ জন নিহত ও ৮১৯ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যা যথাক্রমে ২৮ ও ৪৪। মে মাসে ৩১৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৫ শিশু ও ৩৩ নারীসহ নিহত হয়েছেন ২৯২ জন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৫৮২ জন।
এপ্রিল মাসে সংঘটিত ২৯৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩০৯ জন নিহত ও ৭০৫ জন আহত হয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছেন ৩৮ শিশু ও ৫২ জন নারী। মার্চ মাসে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৯৬টি। এতে ৫১ শিশু ও ৪১ জন নারীসহ নিহত হয়েছেন ৩০৯ জন। আর এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৬২৬ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৩৫৬ জন। আহত হয়েছেন ১১২০ জন। এর মধ্যে ৫৩ জন শিশু ছাড়াও রয়েছেন ৪৯ জন নারী। জানুয়ারি মাসে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৯৫টি। এসব দুর্ঘটনায় ৫৭ জন শিশু ও ৪২ জন নারীসহ ৩৪০ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হয়েছেন ৯৪২ জন।
সংগঠনটির পর্যবেক্ষণে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসের জন্য কয়েকটি প্রস্তাব করা হয়। এরমধ্যে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে গঠনমূলক সংবাদ প্রচার, দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে সামাজিক সংগঠনগুলোর ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও জাল ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিরুদ্ধে অব্যাহত ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা ও পুলিশের দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়। এনসিপিএসআরআর-এর সাধারণ সম্পাদক  আশীষ কুমার দে বলেছেন এ কারণগুলোর সমাধান করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা নেমে আসবে প্রায় শূন্যের কোঠায়।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031